পরিবেশবান্ধব সোনালি আঁশ
বর্ষাকাল আগমনের সাথে সাথে অনেক গ্রাম্য এলাকায় শুরু হয়েছে পাট চাষ। জনবহুল বাংলাদেশে গ্রামীণ গরিব, দুস্ত ও কর্মহীনদের কর্মসংস্থান তৈরিতে পাটের ভূমিকা ব্যাপক। তারা যদি সহজ শর্তে ঋণ পান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে, তাহলে তারা পাটজাত পণ্য তৈরি করে স্বাধীনভাবেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। বহুকাল ধরে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল বা উপাদান পাট। পাট সোনালি আঁশ নামে পরিচিত। একসময় বাংলাদেশে ব্যাপকহারে চাষ হলেও বর্তমানে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আগের মতো এখন আর নদীর পারে, বিলের ধারে পাটক্ষেত চোখে পড়ে না। দিন দিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে আমাদের সোনালি আঁশ পাটশিল্প। মাত্র কয়েক দশক আগেও সোনালি আঁশ ছিল আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য। তখন বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ারও ছিল পাট। তবে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, জুটমিল মালিকদের অজ্ঞতা ও সরকারের উদাসীনতায় পাটশিল্পে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি।
বর্তমানে এ শিল্প অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। যার ফলে, এ শিল্প আগের মতো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ। স্বাধীনতার পর পাটশিল্প আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। সব ভারী শিল্পের মতো পাটশিল্পও জাতীয়করণ করা হয়। সরকার যাদের পাটকলগুলোতে প্রশাসক নিযুক্ত করে তাদের বড় বড় মিল-কারখানা চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রশাসনিক দুর্বলতার সঙ্গে যোগ হয় দুর্নীতি। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন পাটচাষিরা এবং পাটকলগুলো লোকসান দিতে থাকে। যে পাট ও পাটকল ছিল বাঙালির গর্ব তা ধীরে ধীরে বিপর্যয়ের দিকে যেতে থাকে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে আমাদের রফতানি আয় কমে যায়।
বর্তমান সময়ে পাটচাষিদের সমস্যা অনেক। তাদের দুঃখ কষ্টের অন্ত নেই। কিন্তু পাট ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরও সমস্যা ব্যাপক রয়েছে। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র থেকে জানা যায়, পাট কেনার জন্য তাদের ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। সুদের হার প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের কোনো কোনো শিল্পে কাঁচামাল আমদানির জন্য ২ শতাংশ হারেও ঋণ পাওয়া যায়। ওই ধরনের সুবিধা পাটশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও প্রাপ্য। সেটা তাদের ব্যক্তি স্বার্থে নয়, জাতির অর্থনীতির স্বার্থে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষককেও যেমন প্রণোদনা দিতে হবে তেমনি পাটশিল্প ও পাট ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও প্রণোদনা না দিলে এ খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে পাট রফতানি হতো সাড়ে ৫ লাখ টনের মতো। বর্তমানে আড়াই লাখ টন। যেখানে বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে, সেখানে অর্ধেক কমেছে। তবে কাঁচা পাট রফতানি কমলেও পাটজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ২৫-৩০টি ছোট পাটকল স্থাপিত হয়েছে। তাতে কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক পাটকলে বেতন-ভাতার অনিয়ম এবং অন্যান্য কারণে শ্রমিকদের বিক্ষোভের খবরও পাওয়া যায়।
অধিকাংশ পাটকল শ্রমিকের দুর্দশার শেষ নেই। ১৯৭০ সালে পাটের সুতা রফতানি হতো ১৫ হাজার টন, বর্তমানে হচ্ছে ৬ লাখ টন। দেশের ভেতরেও পাটজাত পণ্যের বিপুল পরিমাণ চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রধানত চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, বেলজিয়াম, তিউনিসিয়া, ইরান, এলসালভাদর, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, আইভরিকোস্ট, ব্রাজিল, জিবুতি, ইতালি ও তাইওয়ানে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে থাকে। দেশে গড়ে প্রতি বছর পাট উৎপাদন হয় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ বেল। ভারত এরইমধ্যে বাংলাদেশে পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় রপ্তানি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। সেদেশে বাজার সংকুচিত হওয়ার পর চীনও বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। আর যেটুকু আগ্রহী হচ্ছে তাতে আগের তুলনায় দাম অর্ধেকে নামিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৬৫ শতাংশ পাটের সুতা রপ্তানি হতো তুরস্কে। অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হওয়ায় সেদেশেও রপ্তানি কমে গেছে। এছাড়া পাট ব্যবসায়ীদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটি এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকটও কাটছে না। ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যবহার করা না হলে এক বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে দ্বিগুণ। আইন হলেও আইন আইনের স্থানেই রয়ে যায়। বাস্তবে তেমন কার্যকর হয় না। পলিব্যাগের চেয়ে পাটের ব্যাগের দাম বেশি থাকায় তা ব্যবহারে আগ্রহ কম। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৯(ক) ধারা অনুযায়ী, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পলিথিন উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত, বিক্রি, মজুদ এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কেননা পলিব্যাগ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ আমরা এখন সর্বত্রই পলিব্যাগের ব্যবহার দেখছি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায়ই এমনটি ঘটছে।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় হওয়ায় আমরা বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরতে পারি। পাটতন্তু দ্বারা আকর্ষণীয় শপিং ব্যাগ তৈরি করে খুব সহজেই পাশ্চাত্যের দেশে সুলভ মূল্যে রপ্তানি করা যায়। গবেষণা সংস্থাগুলোকে পাটপণ্য ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট চাষ করা যায় এবং পাটকাঠি, পাটতন্তু, পাট, পাটপণ্যের বিপণন করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কারখানায় শত বছরের পুরনো মেশিন অপসারণ করে নতুন নতুন মেশিন আনতে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। পাটতন্তুর ব্যবহারেও ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে হবে। অ্যাগ্রো টেক্সটাইল, জিও টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল ও হোম টেক্সটাইলে পাটতন্তুর সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকার, মিল মালিক ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ খাতের সকল অস্থিরতা দূর করতে হবে। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে চালিয়ে যেতে হবে নানামুখী প্রচেষ্টা। দেশের ভেতরে পাটজাত পণ্যের বাজার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর রপ্তানিও। বর্তমান সরকার পাট উৎপাদনে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে।
একই সঙ্গে বর্তমান সরকার ৬ মার্চকে ‘জাতীয় পাট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকারের মহৎ উদ্যোগের ফলে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, ভোক্তাসহ প্রায় ৪কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা ফিরে এসেছে। পাট উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকের মূল্য কম এবং আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় খুব সহজেই এ খাত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ এখনো উজ্জ্বল। এতে দেশের বেকারত্বের হার যেমন কমে যাবে, তেমনি শিগগিরই আমরা ফিরে পাব হারানো পরিবেশবান্ধব সোনালি আঁশের সুদিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ