করোনার উপসর্গ হতে পারে পেটের সমস্যাও!
সময়ের সঙ্গে গর্জে ওঠা করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রীতিমতো তাণ্ডব চালাচ্ছে। নিত্যদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সংকটপূর্ণ এই সময়ে মরণব্যাধিটি নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সাধারণ লক্ষণ হিসেবে জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, গা-হাত-পা ব্যথা ইত্যাদিই আমরা জানি। কিন্তু এসব উপসর্গ না থেকেও করোনা পজিটিভ হতে পারে। চীনের বিজ্ঞানীরা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানিয়েছেন, কিছুক্ষেত্রে পেটের সমস্যাও হতে পারে এই রোগের একমাত্র উপসর্গ।
পেটের সমস্যা কেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ হতে পারে তার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এসিই-২ রিসেপটর নামে যে রিসেপটরের মাধ্যমে শরীরে পা রাখে করোনা, তার প্রাচুর্য যেমন শ্বাসনালীতে আছে, আছে পাকস্থলী এবং অন্ত্রেও। কাজেই একের বদলে অন্যটি আক্রান্ত হতেই পারে।
গরম ও বৃষ্টির এই আবহাওয়ায় মাঝেমধ্যে পেটের সমস্যা হতেই পারে। তার উপর লকডাউনে ঘরে বসে ভালো-মন্দ খাওয়া হচ্ছে বিস্তর। এবার তাতেও যদি মিশে থাকে করোনার ভয়, তবে তো বিপদের শেষ নেই!
লেখক ও ইতিহাসবিদ ফার্ন রিডেল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মাসখানেক শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। তবে রোগটা যে কোভিড তা জানতেই কেটে গিয়েছিল কিছুদিন। কারণ, প্রথম দিকে তার ছিল কেবল লুজ মোশন, গা বমি আর পেটব্যথা। দু’-চার দিনে তা কমার বদলে বাড়তে লাগলো। মনে হলো ফুড পয়জনিং হয়েছে। ডাক্তার দেখানো হলো। কয়েকদিনের মধ্যে অবস্থা যখন বেশ জটিল, জানা গেল করোনায় আক্রান্ত তিনি। ১০-১১ দিনের মাথায় পানিশূন্যতা মারাত্মক রূপ নিল। সঙ্গে ভীষণ মাত্রায় গা বমি, ক্লান্তি, গা-হাত-পা ব্যথা ও কাঁপুনি। দিনে ৬ লিটার পানি এবং ওরস্যালাইন চললো। বিছানায় একেবারে মিশে গেলেন তিনি। লুজ মোশন রইল মোটামুটি একইরকম। তারপর আস্তে আস্তে ২৬ দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু ক্লান্তি রইল আরও দিন প্রায় দুই সপ্তাহ।
এটাই হলো গ্যাস্ট্রো করোনা ভাইরাস। ফুসফুসে ঢোকা জীবাণু বেরিয়ে গেলেও পেটে ঢুকলে সে চট করে বের হওয়ার নাম করে না। ভুগিয়ে ক্লান্ত, অবসন্ন করে ফেলে। করোনার আক্রমণে পেটের হাল যখন বেহাল হয়ে যায়, তাকে বলা হয় গ্যাস্ট্রো করোনা।
গ্যাস্ট্রো করোনা সম্পর্কে উহানের ইউনিয়ন হাসপাতাল ও টাঙ্গি মেডিকেল কলেজের বিজ্ঞানীর জানিয়েছেন, অনেক সময়েই করোনা সংক্রমণের রেশ এসে পড়ে পেটে। উপসর্গ বলা হয়েছে, দিনে কম করে বার চারেক পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, বমি, গা বমি। সঙ্গে ক্লান্তি, গা-হাত-পা ব্যথা। এসব রোগীদের রোগ নির্ণয় হতে হতে বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে যায়। কারণ মানুষ বুঝতেই পারেন না বদহজম হলো না অন্য কিছু। তবে গ্যাস্ট্রো করোনার সুবিধা হলো, এক্ষেত্রে সংক্রমণের প্রকোপ মোটের উপর কম থাকে। তবে ভোগান্তির সময়কাল থাকে বেশি।
ভোগান্তি বেশি হয় কারণ, ফুসফুসের কষ্ট কমানোর জন্য অনেক রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়। অক্সিজেন দেয়া হয়। নেবুলাইজারের মাধ্যমে কষ্ট কমানোর চেষ্টা করা হয়। ওষুধপত্রও দেয়া হয় কিছু। কিন্তু পেটের জন্য বিশেষ কিছু করা যায় না। ভাইরাস থেকে হয়েছে, কাজেই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই তেমন কিছু। শুধু স্যালাইন চালিয়ে পানিশূন্যতা কম রাখা হয়। সেজন্য শরীর থেকে ভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত কষ্ট থেকে যায়।
নিউ ইয়র্কের লেনক্স হিল হাসপাতালের এমার্জেন্সি মেডিসিনের চিকিৎসক রবার্ট গ্ল্যাটার জানিয়েছেন, ‘অনেকের ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা দিয়ে রোগের সূত্রপাত হলেও পরে একে একে আসে অন্য উপসর্গ। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য এটাই থেকে যায় মূল উপসর্গ হিসেবে।’
নিউ ইয়র্কের এক দল গবেষক ২০৬ জন মৃদু করোনা রোগীর উপর সমীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের মধ্যে ৪৮ জনের শুধু পেটের সমস্যা ছিল, ৬৯ জনের পেটের সমস্যা দিয়ে শুরু হলেও পরে কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর আসে একে একে। আর ৮৯ জনের ছিল প্রচলিত উপসর্গই- কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর।
গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মল পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাতে ভাইরাস আছে এবং তা সংক্রমণ ঘটাতে পারে। করোনার রোগী মলত্যাগ করার পর হাত ভালো করে পরিষ্কার না করলে সমস্যা হতে পারে। সমস্যা হতে পারে গ্রামেগঞ্জে, যেখানে এখনও যত্রতত্র মলত্যাগের অভ্যাস আছে। এই মল জলে বাহিত হয়ে খাবারে এসে মিশলে, যাকে বলে ফিকো-ওরাল রুট, সেই খাবার খেলে ও সেই জলে বাসনপত্র ধুলে সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন, চিন-এর বিজ্ঞানীরা। বিপদ এড়াতে কয়েকটি সাবধানতার কথা বলেছেন তারা। যেমন—
* টয়লেট থেকে এসে ও খাওয়ার আগে হাত ভালো করে সাবান-পানিতে ধুয়ে নেয়া।
* কাঁচা শাক-সবজি-ফল পানিতে খানিকক্ষণ ভিজিয়ে রাখার পর রগড়ে ধুয়ে নেওয়া।
* জীবাণুমুক্ত পানি পান করা।
* কাঁচা শাক-সবজি-ফল এখন না খাওয়াই ভালো। খেতে গেলে এমন সবজি ও ফল খেতে হবে যা খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়।
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ