একজন ক্ষ্যাপাটে প্রধানমন্ত্রী, ব্রেক্সিট ও ব্রিটেন
চিত্তরঞ্জন সরকার:
বাংলায় প্রবাদ আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে। অধিক লাভের আশায় পড়ে অনেকেই আমরা এমন গরু কিনে থাকি বটে। কিন্তু তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। ব্রিটেনও লাভের আশায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার মানসে ব্রেক্সিট করেছিল। এই ব্রেক্সিটই এখন ব্রিটেনে সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
ব্রেক্সিট-কাণ্ড শুরু হওয়ার পর অসময়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দুইজন প্রধানমন্ত্রী- ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মে। এখন ব্রেক্সিটের চূড়ান্ত টাইমলাইনের মুখে এসে ক্ষমতার জোয়াল চেপেছে বরিস জনসনের কাঁধে। এ বিষয়ে এসপার-ওসপার করতে হাতে সময় আছে দুই মাসেরও কম। এর মধ্যেই চুক্তিসহ বা চুক্তি ছাড়া যেকোনোভাবেই ব্রেক্সিট সারতে হবে।
এই ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে নানা কৌশল ব্যবহার করছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বরিস জনসন ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসে একজন ব্যতিক্রমী ও আলোচিত প্রধানমন্ত্রী। বাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন-এসবের বিবেচনায় তিনি অন্য দশজন রাজনীতিকের থেকে আলাদা। বিয়ে না করেই বসবাস করছেন তার থেকে প্রায় ২৫ বছরের বয়সে ছোটো এক বান্ধবীর সঙ্গে। এ নিয়েও তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
কেউ তাকে বলে থাকেন শিশুসুলভ। কারও ব্যাখ্যায় প্রধানমন্ত্রী তো নয়, যেন বড়লোক বাবা-মায়ের বখাটে ছেলে। উন্নাসিক ব্রিটিশদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত যে এমন একজন ‘বাচাল’ প্রধানমন্ত্রী ছিল তা ভেবেই অনেক সাবেকি নাগরিক রীতিমতো মুষড়ে পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কাণ্ড-কারখানা দেখে ব্রিটেনের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ডমিনিক গ্রিভ যেমন বলেছেন, ‘বরিসের কথাবার্তার সঙ্গে একটি চার বছরের শিশুর অন্যায় আবদারের কোনও ফারাক নেই।’
মজার ব্যাপার হল ডমিনিক গ্রিভ কিন্তু বরিস জনসনের টোরি দলেরই সদস্য। লেবার দলের কেউ এমন কথা বললে না হয় একটা কথা ছিল। ঘরে বাইরে এমনই একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে।
চিরকালই ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক ব্রিটিশ রাজনীতি এবং সমাজে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। বিশ্ব-রাজনীতির অঙ্গনে ব্রিটেন যত অতীত গরিমা হারিয়েছে এবং একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ’র চাকচিক্য বেড়েছে, ততই ব্রিটিশ মননে এই সংবেদনশীলতার মাত্রাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তা চূড়ান্ত আকার নিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগের গণভোটের সময় থেকে। সেই থেকে প্রায় আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে ব্রিটিশ সমাজ। এক দল ভাবছেন, ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই মঙ্গল আসন্ন। আবার আর এক দলের ভাবনা, বিশ্বজুড়ে সংযোগই যখন দস্তুর তখন আলাদা হয়ে যাওয়ার এমন একটা সিদ্ধান্ত বোকামিরই সামিল।
গণভোটের ব্যবস্থা হয়েছিল যাঁর আমলে, সেই ডেভিড ক্যামেরন এবং তাঁর পরবর্তী থেরেসা মে দু’জনেই মানসিক ভাবে ছিলেন ইইউ-তে থেকে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু বরিস জনসন তীব্রভাবে ইইউ’র সঙ্গে যুক্ত থাকার বিপক্ষে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে থাকেন বরিস জনসন-এর মতো সুযোগসন্ধানী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিকরা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। তাঁদের কাছে সুযোগের সদ্ব্যবহার আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাই শেষ এবং একমাত্র কথা। সেখানে আদর্শবাদ, নৈতিকতার কোনও জায়গা নেই। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বরিস জনসন রাজনৈতিকভাবে ম্যাকিয়াভেলির অনুসারী বলা চলে। চূড়ান্ত গন্তব্যস্থলই সেখানে পৌঁছানোর পথ এবং পন্থা ঠিক করে দেয়।
ব্রিটিশ আমজনতাও কিন্তু আপাতত বরিস জনসনের পক্ষে। তার হাস্য-উদ্রেককারী পাগলামি এবং প্রগলভ আচরণকে তারা প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখেন। আর সেই প্রশ্রয় এতটাই তীব্র যে ব্যক্তি-জীবনে হাজারো কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিকে উপেক্ষা করে তাঁকে ব্রিটেনের মতো একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেও আমজনতার কোনো আপত্তি নেই। তাই ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে জনসনের অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগ এবং সংসদে পাশ হওয়া আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর প্রবণতা সত্ত্বেও ব্রিটেনজুড়ে বরিস জনসন-বিরোধী কোনও সামগ্রিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সেভাবে সংগঠিত হয়নি।
যতটুকু যা হচ্ছে তা আগেও হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে প্রতিবাদীরা মূলত ইইউ’তে ব্রিটেনের থেকে যাওয়ার পক্ষে। বরিস জনসনের মতো একজন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর আদর্শবাদের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই, সত্যের প্রতি কোনও আনুগত্য নেই, ব্যক্তিজীবন যাঁর নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিতে বিতর্কিত, সে’রকম একজনের এত সমস্যা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ জনগণের পরিবর্তিত মনোভাবের পেছনে কারণের ইঙ্গিত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরামর্শদাতাদের পরিকল্পনা খুব পরিষ্কার। থেরেসা মে’র ঐকমত্যের পথ ছেড়ে ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে সামাজিক বিভাজনের ফাটলকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানো। এই ফাটল যাতে আরও তীব্র হয় তা নিশ্চিত করতেই নানা আস্ফালন। এই বিভেদকে কাজে লাগাতেই বরিস জনসন সোচ্চারে বলতে পারেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই তিনি ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বের করে আনবেন, তাতে যা-ই হোক না কেন। এমনকী সংসদ যখন চুক্তিহীন বিদায়ের বিপক্ষে রায় দিয়েছে, তখন তা কার্যত মাছি তাড়ানোর মতো উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে বাড়তি সময় চাওয়ার পরিবর্তে তাঁর কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আদতে সবটাই বাজার গরম করে নিজেদের সমর্থকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ।
এমন একটা পরিবেশ তৈরি করার প্রয়াস যার নির্যাস, ‘হয় আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন নয়তো বিপক্ষে’। নিউ ইয়র্কে ২০০১ সালের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পরে প্রেসিডন্ট জর্জ বুশ যেমনটা করার চেষ্টা করেছিলেন। অর্থাৎ এমন একটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা যাতে শত্রু আর মিত্র- এই দুটোর মাঝামাঝি আর কিছু নেই। এই ‘বাইনার’ ব্যবস্থার পেছনে একটাই কারণ। সাদা এবং কালোর মধ্যে বিভেদ রেখাটা এতটাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাতে মধ্যপন্থার পথ সঙ্কুচিত হয়ে সমঝোতার রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে যায়।
বরিস জনসন এবং তাঁর অনুসারীরাই ঠিক তা-ই করতে সচেষ্ট হয়েছেন। মুখে ইইউ’র সঙ্গে দর কষাকষি এবং সমঝোতার কথা বললেও তাঁদের আসল উদ্দেশ্য উত্তেজনার পারদটাকে এতটাই চড়িয়ে দেওয়া যাতে কোনও সমঝোতা ছাড়া বেরিয়ে আসা ছাড়া দু’পক্ষের সামনে আর কোনও পথই খোলা থাকবে না। এই উচ্চগ্রামের রাজনীতির পথ প্রশস্ত করতে কখনও ব্যবহার করা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের তাস আর কখনও উন্নয়নের যুক্তি। ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে যেমন বলা হচ্ছে ইইউ থেকে বেরোতে পারলে ব্রিটেন সার্বভৌম ক্ষমতা ফিরে পাবে যা ব্রিটিশ জনগণের সামনে আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিসরকে আরও প্রসারিত করবে।
এ ছাড়া ইইউ’র সদস্যপদের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত হলে ব্রিটেনের সামনে সারা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ বাড়বে এবং তা হবে একান্ত ভাবে ব্রিটেনের নিজস্ব শর্তে। তবে বরিস জনসনের মতো উচ্চগ্রামের রাজনীতির কারবারিরাই শুধুমাত্র এই নাটকের কুশীলব নন। এর পেছনে একই রকম ভাবে রয়েছে সেই সব প্রভাবশালীদের ভূমিকা যাঁরা আমজনতার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন। এবং তাঁরা চাইছেন জনগণের ভাবনাকে উপেক্ষা করে সব কিছু নিজেদের স্বার্থে এবং শর্তে করতে।
কিন্তু সব কিছু কি এত সহজভাবে হবে? ইতিমধ্যে বরিস জনসন পার্লামেন্টের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্রিটেনে আগাম নির্বাচনের চেষ্টা করে তিনি দুই দফা ব্যর্থ হয়েছেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর আগাম নির্বাচন চেয়ে তার আনা দ্বিতীয় প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশটির আইনপ্রণেতারা। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ছয় বারের মতো হারের মুখোমুখি হলেন প্রধানমন্ত্রী বরিস। এদিন কনজারভেটিভ দলের বিদ্রোহী ও বিরোধী লেবার পার্টির এমপিদের আনা চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট আটকে দেয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ফলে ওই বিলটি আইনে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় ৫ সপ্তাহের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্থগিত হয়ে গেছে। এই প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় চুক্তি চূড়ান্ত করতে ব্রেক্সিট আরও পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে দেশটি যতটা হ-য-ব-র-ল অবস্থায় পড়েছে, নিকট অতীতে দেশটিতে এমন বিশৃঙ্খলা আর দেখা যায়নি। পক্ষে-বিপক্ষের সবাই তাগিদ দিচ্ছে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি পার্লামেন্টে তুললেই সহযোগিতার অভাব দেখা গেছে প্রকটভাবে। কখনো কখনো ক্ষমতাসীন দলের এমপিরাও বিরোধীদের সঙ্গে একমত হয়ে বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে। কখনো বা কয়েকজন শীর্ষ মন্ত্রী একেবারে পদত্যাগ করছেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার বলতে গেলে তার সময়মতো কোনো সমাধান বা সহযোগিতাই পায়নি পার্লামেন্ট থেকে। এ পরিস্থিতিতে ব্রেক্সিট নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা জানতে আরো দুই মাস অপেক্ষা করতেই হচ্ছে বিশ্ববাসীকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সুরমা নিউজ ডট নেট এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)