মৌলভীবাজারের উন্নয়ন ও আমাদের এমপিরা
মৌলভীবাজারে এতবড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বড় অবদান রাখা এ শহরের একটি পরিবারের পাচঁজন মানুষ জীবন্ত পুড়ে মৌলভীবাজার শহরে নিজ বাসায় মারা গেলেন। তাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু শহরবাসীকে বেদনার্ত করেছে। কাদিঁয়েছে মায়ার এ নগরের বহু মানুষকে। এ অপমৃত্যুর আদ্যোপান্ত চোখে আরো একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে- মৌলভীবাজার জেলা শহরে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় চল্লিশ বছর পুরনো একমাত্র পানিবাহী গাড়িটির সক্ষমতা। হবিগঞ্জ,সুনামগঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়,বিশেষায়িত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, হাওরের বুকে নতুন রেল,নতুন শত মাইলের বাইপাস সড়ক সব হচ্ছে।
আর আমরা ? মৌলভীবাজারের মানুষ…
আমাদের জেলা শহরে ফায়ার সার্ভিসে গত ৩০ বছরেও একটা নতুন আগুন নেভাবার নতুন গাড়ী আসে নি। সারাদেশের কথা বাদ ই থাক।আওয়ামীলীগের গত দুই মেয়াদে পাশের হবিগঞ্জ আর সুনামগঞ্জে যে পরিমান নতুন অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়ন কাজ হয়েছে মৌলভীবাজারে তার অর্ধেক কাজ কি হয়েছে? এ জেলার নতুন প্রজন্মের লেখাপড়া,ক্যারিয়ার গড়তে,বা জেলাবাসীর চিকিৎসার্থে বড় পরিবর্তন হবে এরকম কি কোন প্রতিষ্টান গড়ে উঠেছে গত বিশ বছরে জেলা সদরে? হবিগঞ্জে দেশের বড় বড় কোম্পানীগুলো কারখানা খোলায় সে জেলার কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আর আমরা,মৌলভীবাজারের মানুষ, আমাদের জেলা শহরে ফায়ার সার্ভিস অফিসে গত ৩০ বছরেও একটা নতুন আগুন নেভাবার নতুন গাড়ী আসে নি। এটা হল উন্নয়নের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে মৌলভীবাজারের মানুষ দিন কাটান। এত বড় বেদনাবহ একটা দুর্ঘটনা ঘটল। এ আসনের,শহরের একই পরিবারের পাচঁজন যেদিন পুড়ে মারা গেছেন। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতলের শহরের মর্গে ছিল সেদিন সাতটা অপমৃত্যুর শিকার হওয়া মানুষের লাশ। বাকী দুটো সড়ক দুর্ঘটনার। পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান,ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ছিলেন। সাধারন মানুষ আগুন নেভাতে নিজেদের সবটুকু নিয়ে ছুটে এসেছেন। জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার,মেয়র এ ঘটনার শুরু থেকে যে ঘটনাস্থলে ও স্বজনদের পাশে ছিলেন,তা ফেসবুকে আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে দেখি। স্থানীয় সিএনজিচালক মখলিস আগুন নেভাতে জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে এগিয়ে এসে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মৌলভীবাজার শহর বা এ জনপদের মানবিক চরিত্রটা ঠিক কী রকমের;সেটা।
কিন্তু,ঘটনার একদিন পরও সদর আসনের আওয়ামীলীগ বিএনপির বর্তমান বা সাবেক কোন সংসদ সদস্যকে ঘটনাস্থলে দেখেনি সাধারন মানুষ। অথচ, পরিবারটির দুজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত দেশে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে সংসদে তারা এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সদর রাজনগরের বর্তমান এমপি সম্ভবত সংসদ অধিবেশন ছেড়ে আসতে পারেন নি। আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি সম্ভবত অসুস্থ। এখানকার বিএনপির সাবেক এমপি গেছেন সম্ভবত বিদেশে বিয়ের দাওয়াত খেতে।
কুলাউড়ায় ট্রেন গত বছরের ২২ শে জুন রেল সেতু ভেঙ্গে দুর্ঘটনায় পাচঁজন মারা যান। প্রায় দুইশ যাত্রী আহত হন। তারপর জেলার অন্য আসনের এমপিরা ঘটনাস্থলে গেলেও সে আসনের এমপি যিনি, তার দেখা মেলেনি এলাকায় পরের মাসেও।
তিনি আবার জাতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। ভোটের মাঠে চেতনা-বক্তৃতায় নব্বই ডিগ্রী এঙ্গেলে ডিগবাজী খেতে কুলাউড়ার মানুষ তাকে দেখেছিল। কিন্তু,ভোটের পর সেই দুর্ঘটনার কয়েকমাসের মধ্যে এলাকার আসবার তার সময় হয় নি। বিপদের দিনে মানুষ তাকে সান্তনা জানাতেও পাশে পায় নি।
কারন ? সংসদ সদস্যরা তো সংসদ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিয়েবাড়ীতে আগুনে পোড়া, দুর্ঘটনায় মরা পাচঁ, সাত জন মানুষের স্বজনদের সান্তনা দেয়া ,নিজ এলাকায় ট্রেন দূর্ঘটনায় কয়েকশ মানুষ আহত কয়েকজন নিহত হলে এলাকায় যাওয়া, এগুলো তো আসলে সংসদ সদস্যদের কাজ না। তাদের কাজ সংসদে বসে আইন প্রনয়ন করবেন,এলাকার উন্নয়নের প্রকল্প বরাদ্দ আনতে সচিবালয়ে, মন্ত্রনালয়ে ছুটবেন। ভালো কথা। সারাদেশের জনপ্রিয় সাংসদরা সংসদেও থাকেন, এলাকায়ও থাকেন। তাদের এলাকায়গুলোতেও উন্নয়ন হয়েছে। কিন্ত, মৌলভীবাজারের সে তুলনায় উন্নয়ন কতটা উন্নয়ন হচ্ছে,এ প্রশ্নটা এ জেলার একজন নাগরিক হিসেবে খুব কষ্ট দেয়। এক দুজন ব্যাতিক্রমও অবশ্য আছেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সৈয়দা জহুরা আলাউদ্দীন বয়োজৈষ্ট্য মানুষ। তবু তাঁকে সংসদের পাশাপাশি মৌলভীবাজার-সমশেরনগর সড়কের উন্নয়ন কাজের অনিয়ম তদারকীতেও সক্রিয় দেখা যায়।
আমাদের এমপিরা সংসদে সময় দেন, এলাকার উন্নয়নে কথা বলেন। ফেসবুকে ছবি দেন, একজন তো আবার রীতিমত লোকই রেখে দিয়েছেন নিজের নামের আগে-পিছে জাতীয় নেতা, সমর্থক ও ভক্ত লিখে ফেসবুক একাউন্টগুলো চালানোর জন্য।
আমাদের সাংবাদিকরা বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যু নিয়ে মানবিক ষ্টোরী লিখে কাভারেজ পান। কিন্তু, জেলার উন্নয়ন বঞ্চনা জাতীয় গনমাধ্যমে কাভারেজ পায় না।
উন্নয়নের বঞ্চনা নিয়ে সামাজিক সংগঠনগুলো অবশ্য সরব দেশে বিদেশে সরব। বহু নামে বহু সংগঠন নামের দোকানের ব্যানার,ফটোরাজনীতি। তাদের কর্মকান্ড গোলটেবিল, মতবিনিময় সভা আয়োজন, ফেসবুকে ছবি আপলোডের মাধ্যমে নিজেদের বেচেঁ থাকা ও অস্তিত্ব জানান দেবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে।
লেখক- লন্ডনে কর্মরত সাংবাদিক
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ