গুঞ্জন
বাসার ছাদটিকে অভিনব কায়দায় সাজানোর এই পরিকল্পনাটি তাহেরের দীর্ঘ দিনের স্বপ্নের ফসল বলা যেতে পারে।দোতলা বাসার ছাদের প্রায় পুরোটাকেই সুইমিংপুল বানিয়েছিল তাহের।সুইমিংপুলের চারপাশ জুড়ে ছিল মাঝারি মাপের কিছু মাথা উঁচু করা সরু সরু গাছ।বিশাল ছাদ জুড়ে গড়া সুইমিংপুলটির মাঝখানে একটা ছোট্ট ঘরও ছিল যার মেঝেটা ছিল পানি ছুঁই ছুঁই,চারপাশ ছিল স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা আর ছাদটা ছিল টিনের।বৃষ্টিকালে বৃষ্টি পতনের শব্দ শোনার জন্যই টিনের ছাদ।মেঝেতে বিছানো নরম বিছানায় শুয়ে চাঁদের আলো গায়ে মাখার জন্যেই স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল।ঘর লাগোয়া পানিতে ডুবন্ত একটা মেঝেতে রাখা রকিং চেয়ারে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে বই পড়া ছিল তাহেরের অন্যতম শখ।সুইমিংপুলের পাড় থেকে ঘরে আসার সিড়ির দুইপাশে টবে টবে ছিল বাহারি কিছু সুগন্ধি ফুলের গাছ।অবসরের বেশিরভাগ সময়টাই তাহের কাটাতো তার নিজ পরিকল্পনায় গড়া প্রিয় স্বপ্নরাজ্যে আর চারপাশে সাউন্ড সিস্টেমে মৃদু আওয়াজে বাজত তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত।স্বপ্নরাজ্য পুরোটাই আপন জায়গায় স্থির।কেবল স্বপ্নবাজ মানুষটিই নেই,মানা যায়?
তাহেরের কূলখানি হয়ে যাওয়ার পর স্বজনে গমগম করা ফ্ল্যাটটিতে এখন কেবল সুনসান নিরবতা।আকাশি রঙের টাইলসে গড়া সুইমিংপুলের স্বচ্ছ পানিতে কারো পায়ের পাতা ভিজে ওঠে না আজকাল,রঙ বেরঙের ফুল গাছগুলোর গায়েও কারো আলতো হাতের স্পর্শ মিলে না,সময়ে অসময়ে মৃদু শব্দে ছাদ জুড়ে বেজে ওঠে না রবি ঠাকুরের গান।নিচতলার বাড়াটিয়ারাও যেন একটু বেশিই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ ঝিমুনিতে থাকা দারোয়ানটাও নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছে। ২৪০০ স্কয়ার ফিটের দোতলার আলিশান ফ্ল্যাটটিতে এখন একমাত্র প্রাণী বলতে তমা,শারমিন তমা,একটি বিদেশি ঔষধ কোম্পানির সিনিয়র সাইন্টিস্ট।দীর্ঘদিনের প্রেমিক তাহেরকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে বিয়ে করেছিল তমা।দিনকয়েক পরে তাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী পালন করার কথা ছিল।অথচ এর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল তাহেরকে।প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রতিটি জীবকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়।তাই বলে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতে তার মৃত্যু হবে এই ভাবনা কস্মিনকালেও কি ভেবেছে তাহের?শুধু তাহের নয় পৃথিবীর কোন মানুষ মনের ভুলেও ভাবতে পারেনি এত সুন্দর এই জুটির মাঝে মর্মান্তিক এমন পাশবিক ঘটনা ঘটতে পারে।তাই নিজে হাতে ঘটানো এই হত্যাকাণ্ডকে সহজেই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালিয়ে দিতে পেরেছিল তমা।সারাবছর উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাহের এর আগে একবার স্ট্রোক করেছিল তাই ২য় স্ট্রোকেই তার মৃত্যু হয়েছে বলেই জগতবাসী জানে।কেবল ঈশ্বর জানে প্রিয়তমার হাতে কি ভয়ানক নির্মল, প্রশান্তির মৃত্যুসুধা পান করতে হয়েছিল তাহেরকে।
তাহেরর মৃত্যুতে কোন অনুশোচনা নেই তমার, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা আছে।ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই মৃত্যুটি দরকার ছিল।ভালোবাসার মানুষকে মনে প্রাণে ঘৃণা করার চেয়ে তাকে হারিয়ে কাঁদা অনেক ভালো।মৃত্যুটি তাহেরের না হয়ে তমারও হতে পারত কিন্তু ব্যাংক ঋণ নিয়ে করা বাড়ির ঋণ পরিশোধ করা চিরকালীন বেকার তাহেরর পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হত না।তাছাড়া তাহেরের ভালোবাসা বুকে নিয়ে তমা যেভাবে জীবন কাটিয়ে দিবে তাহের তা কোনদিনই তা পারতো না।তমার মৃত্যুর চল্লিশ দিন না যেতেই তাহের বিয়ে করত তার নতুন প্রেমিকা রিনা কে।হ্যাঁ রিনা,তাহেরের নতুন প্রেমিকা যার ভয়ংকর ছোবলে তমার পাঁচ বছরের সংসার বিষে নীল হয়ে যেতে পাঁচ সপ্তাহ সময়ও নেয় নি।তমা ভেবেই পায় না তাহেরের মত এত ভদ্র একটা ছেলে কিভাবে তার অনুপস্থিতিতে তার নিজের বাসভবনে একটা বাহিরের মেয়ে কে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে পারে।নিচতলার ভাড়াটিয়া বা দারোয়ানের কান কথা কানে তোলে নি তমা।তবে নিজ চোখে দেখে আর নিজে সব প্রমাণপত্র হাতে পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি তমা, প্রচণ্ড ক্রোধে স্বামী হত্যার মত জঘন্য কাজটি তাকে করতে হল।কয়েকবার ইচ্ছে হয়েছিল রিনা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করবে তাহের কে।কিন্তু রুচি হল না।যে স্বামী তার স্ত্রী কখন বাসায় অনুপস্থিত থাকবে তা নিশ্চিত হয়ে যুবতি একটি মেয়েকে বাসায় আসতে নিরবে ফোন করে,এস এম এস করে তার মনের কুবাসনা বুঝতে একজন বিবাহিত নারীর কষ্ট হওয়ার কথা না।চাকরি সূত্রে বিভিন্ন পুরুষের সাথে কাজ করা তমা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই ভদ্রবেশের অন্তরালে অনেক পুরুষের লালায়িত লোলুপ কুবাসনার সাক্ষী।সেই পুরুষ নির্জন পরিবেশে একজন যুবতি নারীর সঙ্গ কেন চায় তা বুঝতে পুরুষের উপর পি এইচ ডি করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।অতঃপর ভালোবাসার মানুষটিকে ঘৃনা করার সময়টি দীর্ঘায়িত না করার হাতিয়ার হিসেবে সে বেছে নিয়েছিল পটাশিয়াম সায়ানাইড নামক ভয়ংকর কেমিক্যাল,যা King of Poisons নামে পরিচিত।ভয়ংকর এই কেমিক্যালটি গ্রহণের কয়েক মিনিটের মধ্যে মানুষের মৃত্যু ঘটে।সায়ানাইড আয়ন শরীরের কোষে অক্সিজেন শোষণ করতে বাঁধা দেয়।অক্সিজেনের অভাবে শরীরের কোষের Power House মাইটোকন্ড্রিয়া শক্তির জোগান দিতে পারে না।ফলে শরীরের বাকি নির্ভরশীল কোষগুলো তাদের মধ্যকার সামান্য শক্তি খরচ করে শেষ পর্যন্ত মারা যায়।এভাবে শরীরের বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ কোষ মরে গেলে মানুষের মৃত্যু ঘটে।মৃত্যুর কারন হিসেবে দেখানো হয় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব।মানুষের জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইডের লেথাল ডোজ ২০০-৩০০মিলিগ্রাম।অর্থাৎ একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য ২০০-৩০০মিলিগ্রাম পটাশিয়াম সায়ানাইডই যথেষ্ট।একজন সিনিয়র সাইন্টিস্ট হিসেবে পটাশিয়াম সায়ানাইডের লেথাল ডোজের পরিমাণ তমার অজানা নয়।তারপরও যদি কোনদিন পৃথিবী ছাড়ার ইচ্ছে নিজের মনে বাসা বাঁধে তাই নিজের জন্যও যেন কাজে লাগাতে পারে সে হিসেব করে ১০০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম সায়ানাইড যোগাড় করল সে।
বাতাসে সেদিন বসন্তের ঘ্রাণ,আকাশ জুড়ে চাঁদের কিরণ।এ রাতে তাহেরকে ঘরে বেঁধে রাখা যায় না।রাতের খাবার শেষে তাহের তমাকে জিজ্ঞাসা করল,
-আজ ছাদে শোব আমি,তুমি যাবে?
-হ্যাঁ,যাবো।তুমি যাও,আমি খাবার গুলো গুছিয়ে আসছি।
-বোতলটা নিয়ে আসবে?
-হ্যাঁ আসবো।
-আচ্ছা,তোমার তো কাল অফিস বন্ধ,ওভারটাইমে যেতে হবে?
-না।
খানিকক্ষণ মোবাইল চাপাচাপি করে ছাদে চলে গেল তাহের।ছাদে মোবাইল নেয় না বলে বিছানার উপর পড়ে আছে বস্তুটি।হাতের কাজ শেষ করে তাহেরের মোবাইলটি নিল তমা।সেন্ড আইটেমে কিছু নেই,চ্যাটেও না।ডিলেটেড আইটেমে রিনাকে সদ্য সেন্ড করা এস এম এস টি পড়ে আছে।
“তমা কাল বাসায় থাকবে।কাল এসো না,পরশু এসো।“
চোখ দুটো জ্বলে ওঠে তমার।অনেক ভেবেছে সে তাহেরকে ক্ষমা করা যায় কিনা,সম্ভব হলো না আর।আকার ইঙ্গিতে অনেক বুঝিয়েছে রিনার বিষয়ে সব জানে সে।আর ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না তার তাও বুঝিয়েছে,তাহেরও সব বুঝেছে কিন্তু আচরণ পাল্টায় নি।বাবা মায়ের অমতে চালচুলোহীন বেকার তাহেরকে বিয়ে করেছিল তমা।তাহের নিজের বেকারত্ব তখনো ধরে রেখেছিল।নিজে চাকুরী করে সংসার চালিয়ে এক টুকরো জমি কিনে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তাহেরের মনের মত একটা বাড়ি করেছে তমা।অফিস থেকে দেয়া গাড়িটিও নিজে ব্যবহার না করে রেখে দিয়েছে তাহেরের জন্য।আর নিজে অফিসে যায় লোকাল বাস বা রিক্সায় চড়ে।তাহের পিতা হওয়ার সামর্থ রাখে না বলে সম্পূর্ণ সুস্থ্য তমাকেও বন্ধ্যা অপবাদ শুনতে হয়।মা হওয়ার স্বপ্নটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে কেবল তাহেরের অক্ষমতায়।আর সেই তাহের দিনের পর দিন হিপোক্রেসি করে যাবে আর তমা মুখ বুজে তা মেনে নেবে,তা কি হয়?
তাহেরের প্রিয় রেড ওয়াইনের একটা পেগ প্রস্তুত করল তমা এর আগে গ্লাসে প্রায় ৪০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম সায়ানাইড ঢেলে নিল।উপরে খানিকটা বরফ কুচি।পটাশিয়াম সায়ানাইডের স্বাদ তিক্ত এলমন্ডের মত কিন্তু সবাই এই স্বাদ পায় না।তাহেরও পাবে না কারন রেড ওয়াইনের গ্লাস টা দেখার সাথে সাথে এক চুমুকে প্রিয় পানীয়টা গলায় ঢেলে ফেলবে সে।
মধ্যরাত,আকাশ ভেঙ্গে জোছনা ঝরছে।হাতের কাজ সেরে তমা ছাদে উঠল,বসন্তের মৃদু বাতাস তমার চুলের ভাঁজ খুলতে ব্যস্ত আর তাহের ব্যস্ত চাঁদের কিরণ গায়ে মাখতে।ছাদের সব লাইট নিভিয়ে দিয়েছে তাহের।ছাদের লাউড স্পিকারে মোলায়েম সুরে বেজে চলছে পুরোনো দিনের চিরসবুজ কিছু গান।পরিবেশটাই খানিকটা এলোমেলো করে দেয় তমাকে,খানিকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে সে। তার জীবনের একমাত্র প্রেমিক,একমাত্র পুরুষ তাহের।যাকে ছাড়া এই জীবনে আর কোন প্রেমিক নেই আর কোন পুরষ নেই,তাকে ছাড়া একা একা বাঁচবে কি করে তমা?মনকে বুঝায় তমা একবার না হয় তাহেরকে বুঝিয়ে বলা যায়।মানুষইতো ভুল করে,ভুল স্বীকার করে তাহের যদি তমার কাছে ফিরে আসে তাইলে আপত্তি নেই তার।তবে এবারও যদি কোন প্রতারণার আশ্রয় সে তাইলে আর ক্ষমা নেই রেড ওয়াইন্ডের এই প্যাগই সব প্রতারণার দরজা বন্ধ করে দিবে এবার।
সুইমিংপুলের মাঝের ঘর লাগোয়া চেয়ারে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে চাঁদ দেখছে তাহের।গানের তালে তালে চেয়ার দুলাচ্ছে সে।পা নেড়ে নেড়ে ছোট ছোট ঢেউ তুলছে সুইমিংপুলের বুকে কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরেই সেই ঢেউ পানিতেই মিলিয়ে যাচ্ছে,অপর পাড়ের দেখা আর মিলছে না।তাহের আরো জোরে জোরে পা নাড়ছে যেন ঢেউ অপর পাড় পর্যন্ত যায়।কিন্তু তা হচ্ছে না দেখে পা নাড়ানো বন্ধ করে রেখেছে সে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায় পানি,টলটলে পানিতে ঝলমলে চাঁদের কিরণ।আহা,পৃথিবীটা এত শান্তিময় কেন?নিজে নিজেই ভাবে তাহের।প্রশ্নের উত্তরও নিজে নিজেই পেয়ে যায় সে।স্রষ্টা তমার মত এতো লক্ষ্মী একটা মেয়েকে তার জীবনে পাঠিয়েছে বলেই জীবন এত আনন্দময়।সামনেই তাদের ৫ম বিবাহ বার্ষিকী,এই বিশেষ দিনে আনন্দ সঙ্গীকে কি কি ভাবে চমকে দেয়া যায় তা ভেবেই দারুণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তাহের।তমার কথা ভাবতেই মনটা দারুণ শীতল হয়ে যায় তার।ঠিক এই সময়েই একেবারে নিঃশব্দে তাহেরের পেছনে এসে দাঁড়ায় তমা।নিঃশব্দে এলেও তাহের ঠিকই বুঝতে পারে প্রিয়তমা স্ত্রী তার পেছনে,এতদিনে স্ত্রীর নিঃশ্বাসের শব্দও মুখস্থ হয়ে গেছে তার।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তাহের,আলতো করে জড়িয়ে ধরে প্রিয়তমা স্ত্রীকে।কপাল বরাবর এঁকে দেয় ছোট্ট একটি চুমো।নিজের ঠোঁট স্ত্রীর ঠোঁটের বরাবর নেয়ার আগেই নিজেকে সরিয়ে নেয় তমা।ঠান্ডা গলায় তাহেরকে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা তাহের,তোমার কি মনে হয় আমাদের মধ্যে গোপন কিছু থাকা উচিৎ?
স্ত্রীর প্রশ্নের ধরন দেখে খানিকটা চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তাহের উত্তর দেয়,
-প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কিছু থাকতে পারে তমা,এটাইতো স্বাভাবিক,তাই না?
-স্ত্রী হিসেবে তোমার সব কথা জানার অধিকার আমি রাখি না?
-জানোই তো,সবইতো জানো।
-তারপরও আজকাল আমার মনে হয় আমার জানার বাহিরেও তোমার অনেক সত্য আছে এবং তা আমার জানা খুব জরুরী।
-এমন কিছু মনে হয়ে থাকলে সেটা তোমার মানসিক সমস্যা।আর তোমাকে জানানোর মত এমন কোন গোপন সত্য আমার নেই।
মানসিক সমস্যা শব্দটা শোনার পরই মাথাটা গরম হয়ে যায় তমার।যে পুরুষ বাহিরের একটা মেয়ের জন্য নিজের স্ত্রীর মানসিক সমস্যা আছে বলতে পারে তার সাথে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।রেড ওয়াইনের গ্লাসটা তাহেরের হাতে দিয়ে হনহন করে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায় তমা।অবশ্য রাগের তীব্রতায় সে ভুলেই গিয়েছে স্বচ্ছ এই গ্লাসটায় পটাশিয়াম সায়ানাইড নামক প্রাণঘাতী স্বচ্ছ কিছু উপাদান মিশানো রয়েছে।তাহেরও নিয়মিত অভিমান করা স্ত্রীর রাগকে পাত্তা না দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলো।রাগ কমার পর তমার যতক্ষণে পটাসিয়াম সায়ানাইডের কথা মনে পড়েছে ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে।পাগলের মত দৌড়ে ছাদে উঠে তমা বুঝতে পারলো তার জীবনে তাহের আর বর্তমান নেই,কিছক্ষন আগেই সে অতীত হয়ে গেছে।তমা বসে আছে জল সিঁড়িতে,তার দুপা পানিতে ডুবানো,পাশে সুইমিংপুলের পানিতে অর্ধ ডুবন্ত তাহেরের নিথর দেহ।যেন তেমন কিছুই হয় নি মুগ্ধ নয়নে প্রেমিক পুরুষ কেবল প্রিয়তমা স্ত্রীর রূপ সুধা পান করছে।তখনো ছাদ জুড়ে মৃদু শব্দে বেজেই চলছে তাহেরের প্রিয় গানের একটি,শ্রীকান্ত আচার্যের গান,
-পথে পথে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন থেমে যাবো। মেঘলা রাতে লুকিয়ে থেকে রূপোর আলোয় জ্যোৎস্না হবো।
দেখতে দেখতে তমা ও তাহেরের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী ঘনিয়ে এলো।অথচ পাঁচ পাউন্ডের কেক এর অর্ডার দেয়ার তাড়া নেই।কারও গিফট দেখানো হবে না বলে লুকোচুরি নেই।তমা বসে আছে জলসিঁড়িতে অবসরের বেশিরভাগ সময়ই আজকাল এখানটাতে কাটে তার।হঠাৎ তার পেছন দিক থেকে নারী কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাল সে।ছিপছিপে গড়নের সুন্দরী মেয়েটির হাসিমুখ দারুণ মুগ্ধ করল তাকে।কিন্তু কখনো না দেখা রিনার নামটি শোনার পর মুখের মাংসপেশি গুলো শক্ত হয়ে গেলো তমার।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জানতে চাইল,
-আমার কাছে কি মনে করে?
-আসলে ম্যাম,তাহের স্যারকে দরকার ছিল।কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ ওনার সাথে কন্টাক্ট করতে পারছিলাম না তাই।
-ওনার সাথেই বা কি দরকার তোমার?
-তাতো ম্যাম আপনাকে বলা যাবে না।আমার ওনাকেই দরকার।
-রিনা, ওনার সাথে তুমি আর কখনোই কন্টাক্ট করতে পারবে না।সুতরাং যা বলার আমাকে বলতে পারো নতুবা আসতে পারো।
খানিকটা ভাবনায় পড়ে যায় রিনা।তাহেরকে ছাড়া জিনিসটি তমাকে দেয়া যায় কিনা তাই ভাবছে।ভেবে দেখলো তাহেরকে না পেলে তো তমাকেই তো দিতে হবে। দিবেই যখন একটু আয়োজন করেই দেয়া যাক।
-ওকে ম্যাম,আপনি কি পাঁচ মিনিট সময় দিবেন আমাকে?মানে ঠিক পাঁচ মিনিট পর এখানে আবার আসবেন আপনি,এর আগে নয়।
-ওকে।
খানিকটা দ্বিধা মনে নিয়ে নিচে গেলো তমা।
পাঁচ মিনিট পর উপরে এসে যা দেখলো তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না তমা।রকিং চেয়ারের পাশে একটা স্ট্যান্ডে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে একটা তৈলচিত্র।যাতে আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে,জলসিঁড়িতে বসা তমার পায়ের কাছে অর্ধডুবন্ত তাহের মুগ্ধ নয়নে দেখছে তার প্রিয়তমাকে।
-ম্যাম,শুভ বিবাহবার্ষিকী,আমি একজন চিত্রশিল্পী।ম্যাম,আপনাকে দেখে হিংসে হয় আমার,আপনি খুবই ভাগ্যবতী একজন নারী ম্যাম,তাহের স্যার এর মত একজন মানুষকে পেয়েছেন বলে।জানেন ম্যাম?আপনাকে সারপ্রাইজ্ড দিবে বলে ছবি আঁকার সময় আপনাকে রাখে নি স্যার। আপনার এই পজিশনে একটা ছবি দেখে ছবিটি আঁকতে হয়েছে আমাকে।তবে জীবন্ত একটি ছবি আঁকার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে ডুবে পোজ দিয়েছিল স্যার।স্যারকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন ম্যাম।আর ছবিটি কি আপনার পছন্দ হয়েছে ম্যাম?
নিজের জীবনের সকল হিসেবকে ভুল প্রমাণ করে দেয়া ক্যানভাসটির দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলো তমা।ছবিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-হ্যাঁ,দারুণ পছন্দ হয়েছে।
দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া তমার চোখ থেকে এবং তা পড়ল তমার ছবির উপরেই,তার বাঁ চোখের উপর।যেন ছবিটিও কাঁদছে,,,
লেখকঃ বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান