বাউণ্ডুলেঃ ‘অস্তিত্ব অভিলাসী’

আমি বাউণ্ডুলে। স্থিতিহীন জীবন বহতা নদীর মতো অবিরাম এগিয়ে চলছে। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাকে পাগল বলতেও ছাড়ে না। আমি হাসি, শুধু হাসি, কিছু বলি না, বলতে পারি না; মুলত বলার কিছু থাকে না। এ রকম সম্বোধনে কিছু না বলাই আমার মতো বাউণ্ডুলের জন্য উত্তম- এ কথাই ভাবি।

আমি বাউণ্ডুলে। বিক্ষিপ্ত অবাঞ্চিত হয়ে নিশি-দিন প্রতিদিন অতিবাহিত করছি। এমনই প্রতিদিনের একদিন সন্ধ্যায় দেখা হলো পাঁচ বছর আগে শেষ দেখা হওয়া এক বন্ধুর সাথে। বন্ধুটিকে ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসা দেখে অবাক হলাম- আমার মতো অভাগার স্থানে তার মতো উজ্জ্বল ব্যক্তি বসে থাকবে কেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়! বন্ধুটি আমার অনেক সুখি দেখেছি- এই তো সেই পাঁচ বছর আগে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। ভালো একটা চাকরীর বদৌলতে সমাজে তার ভালো একটা অবস্থানও ছিল। সে প্রেক্ষিতে তাকে এ অবস্থায় মানায় না। আমি তার কাঁধে হাত রেখে ‘‘কেমন আছো?’’ বলতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তারপর এক করুণ কাহিনী শুনলাম। যার সারমর্ম হলো- পরকীয়া। সেই পরকীয়া নামক ভাইরাস তার সুখের সংসারে অজান্তেই ঢুকে যায়। আক্রান্ত হয় তার সুন্দরী বধু। ফলস্বরূপ- স্বামী সন্তান রেখে সঞ্চিত সব সম্পদ নিয়ে সুখের আশায় খুব নিখুত ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে পালিয়ে যায় অন্য একজনের সাথে। এলোমেলো করে যায় একটা সুন্দর বৈধ্য আশ্রয়কে- যে সত্যিকারের আশ্রয়ের দেখা পাওয়া এই আধুনিক যুগে অনেক কষ্টের, অনেক ত্যাগের।

বন্ধুটিকে সমবেদনা জানাই অন্তরের অন্তরস্থল থেকে। আর নিজেকে ধন্যবাদ জানাই- আমি বাউণ্ডুলে বলে। এই নিখুত প্রতারনার শিকার হওয়ার আগেই অন্য পথ বেছে নেওয়ায় আজ আমি সবার কাছে পাগল হলেও ভালো আছি; বেশ ভালো আছি। আমাকে হঠাৎ করে আর অবাঞ্চিত হতে হবে না এই ঘুনে ধরা সমাজে। হঠাৎ করে অবাঞ্চিত হাঁটা হাঁটতে হবে না নিশিরাতে, ফুটপাতে। আমি যে অনেক আগেই অন্য এক প্রতারনায় প্রতারিত হয়ে এই রঙিন সমাজের চোখে অবাঞ্চিত সেজে ফুটপাতকেই আপন ঠিকানা করে নিয়েছি। আর বসে বসে দেখছি- পরাবাস্তব নীলে ঢুবে যাওয়া অনন্ত আশা নামক ভেলার সলীল সমাধি। আর হাইওয়ে রোডে অরন্য শিকারীর দূর্বার গতি দেখে বুকে নিকোটিন জমা করছি। শুনছি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন মনের ভুলে, নিজের অজান্তে, উত্তপ্ত রেড এলার্ট ঘোষিত সীমান্তের প্রান্তে।

আমি রঙিন সামিয়ানা টাঙানো আশা ভালোবাসার জনসমাবেশে দেখেছি কতো করুণ মুখ, অসময়ে ফেটে যাওয়া চৌচির বুক, অসহায় নিষ্পাপ শিশুদের অসহায় নিষ্পাপ অশ্রু। কালবৈশাখীর তান্ডবে লণ্ডভণ্ড হওয়া একটা সংসার; যেখানে আশা নিরাশার দোলায় দোলে না মন। শুনা যায় শুধু চুরি হয়ে যাওয়া স্বপ্নের অবুঝ ক্রন্দন। এসব দেখে আমি বিক্ষিপ্ত হই। খুঁজি অতীতের ছায়া, খুঁজি একটা শুদ্ধ প্রহরের শুভ্র মায়া। কিন্তু স্মৃতির প্রতারনায় বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি নিজেরই কাছে। মন-মস্তিষ্ক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আর আমি নিরব দর্শক হয়ে পলকহীন চেয়ে রই দৃষ্টিহীনদের মতো।

এই পরকীয়া বিষে নীল হয়ে ছিলেন বিশ্ববিখ্যাতরাও। আমি তাদের নিরব ক্রন্দন আজও শুনতে পাই। কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনা- তাদের মেধা, জ্ঞান, বুদ্ধি সর্বপরি তাদের খ্যাতি সব ভুলে কেন যে অবৈধ্য একটা মোহে পড়ার জন্য এত ব্যকুলতা তাড়া করছে! কবিগুরু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর প্রেম ‘‘তোমাকেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’’ নামক কবিতার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। এই পরকীয়ার ফল স্বরূপ দেখা যায়, কোনদিনই নিজের বিবাহিত স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সাথে কবির হৃদয়ের যোগ তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

বিদ্রোহী কবি নজরুলের বাধনহারা প্রেম খুজলেও অনেক যন্ত্রনার অস্পষ্ট শব্দ শুনা যায়। নার্গিসের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করলেও বাসর রাতেই কবির পলায়নের সারমর্ম খুঁজলে হয়তো এই পরকীয়া বিষই পাওয়া যাবে। ভাওয়াল রমনী বিভাবতী আর পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্তের উদ্দাম প্রেম দার্জিলিংয়ের শৈল নিবাসে মুমূর্ষ স্বামী মেজোকুমারের চোখের সামনে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তা আমাকে কেন সমস্ত পৃথিবীকে ক্ষণিকের জন্য নাড়িয়ে দিয়েছিল; ক্ষণিকের জন্য কাঁদিয়েছিল। আর সেই ঘটনা মনে করেই আমার অস্তিত্ব আমাকে কাঁদায়। এত কষ্ট আমার দ্বারা সহ্য করা সম্ভব হবে না। তাই আমি বাউণ্ডুলেই রব। এতেই সব শান্তি নিহীত রয়েছে। রয়েছে আশা নিরাশার রঙিন এক সোনালী স্বপ্ন। রয়েছে কাশফুলের মতো নরম ছোঁয়া। রয়েছে অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার রাতে নিজের অজান্তে বত্রিশ পাটি বাহির করে মাতালের মতো হেঁটে হেঁটে রাত কাটানোর মতো এক শুভ্র আলোড়ন। হ্যা- আমি পারবো এমন থাকতে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ওসমানী কিংবা শাহাজালালের মতো দরবেশ বিয়ে না করেই শুভ্র একটা জীবন কাটাতে পেরেছেন। সেখানে আমি কেন পারবো না। তাদের তুলনায় আমি তো অতি তুচ্ছ, অতি নগন্য।

আমি তোলপাড় হই যখন দেখি- একটা মেয়ে অবুঝ একটা শিশু কোলে নিয়ে অন্যের স্বামীর কাছে স্ত্রীর মর্যাদা ও সন্তানের পিতৃপরিচয়ের জন্য নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এসব দেখে দেখে আমি নিজের কথা ভাবি। ভাবি ভালোই তো আছি এমন সংসার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাযাবর এক পথিক হয়ে বেঁচে থেকে।

ছোট বেলায় পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা পড়েছিলাম। সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমের পরকীয়ার আগুন তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি সে আগুন কিভাবে সবকিছু পুড়াতে ক্রমশ বেগবান হয়েছিল। আর বর্তমান সময়েও এই আগুনের হাজার হাজার স্পষ্ট প্রমান রয়েছে। নিজ উদরে দশটা মাস অনেক কষ্টে লালন করে তাকে পাওয়ার প্রয়াশে নিজের অস্তিত্ব বিলিন করে যখন দেব শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখায় একটা মা তখন তার মাতৃত্বের কাছে সব কষ্ট বিলিন হয়ে যায়। কিন্তু এরপর আমি বুঝে উঠতে পারি না। কিভাবে নিজের দৈহিক ক্ষণস্থায়ী চাহিদা পূরণের নিমিত্তে আপন সন্তানের রক্তে নিজ হাত রক্তাক্ত করে পাষানের মতো মীরজাফরের মতো ক্ষণস্থায়ী নীড় গড়ে বালুচরে। সেই ঘটনাকে, সেই অভিব্যক্তিকে কিভাবে বিন্যাস করবো বুঝতে পারিনা। মনে হয় পারবও না। তাই সেই সাহস না করে শুধু ভাবি। এলোমেলো ভাবে ভাবি।

ভেবে পাই না স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি এই আমরা কিভাবে তার ঘোষিত বাক্যকে উল্টে দিয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনকে চিরস্থায়ী ভাবি। ভেবে পাই না আমরা কিভাবে একসাথে একজনের স্বামী অন্যজনের প্রেমিক; একসাথে একজনের স্ত্রী অন্যজনের প্রেমিকা হই। ভেবে পাই না ক্ষণিকের মোহে পড়ে কিভাবে নিজের নাড়ী ছেড়া ধনকে গলা টিপে খুন করি। আমি ভেবে পাই না, কেন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না- দৈহিক প্রেম তথা নিষিদ্ধ চাহিদা আমাদের কোন পরিনতির দিকে ঠেলে দেয়।

আমি প্লাটফর্মে শুয়ে শুয়ে ভাবি- জীবনে প্রেমের কারুকাজ তেমন কিছু ছিল কি না! ভাবি, কেন নিজের পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব করিনি কোনদিন। করেই বা কি লাভ? যোগফল শূন্য ছাড়া কিছু হবে না। তবুও আশায় আছি ভরসায় বুক বেধে। প্রত্যাশার ট্রেন আসবে ভালোবাসার যথার্থ রূপ নিয়ে। তখন হবে এক নতুন অস্তিত্ব। হবে একটা সহানুভূতিশীল সমাজ। যেখানে পবিত্র ভালোবাসা ও বৈধ জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ ছেড়ে নিষিদ্ধের প্রতি আসক্ত হওয়ার কোন প্রয়াস থাকবে না।

আমরা সঠিক হবো, বিপথগামীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেব- এটা ভুল পথ। ইতিহাস ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস গড়ব। সেখানেও আমি আমার মতো থাকব। থাকব অবাঞ্চিত হয়ে ফুটপাতে। থাকবে আমার নিশ্বাস, থাকবে আমার বিশ্বাস- ঠিক এখনকার মতো বাউণ্ডুলে রূপেই।

লেখকঃ কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ