জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশে প্রভাব
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরাই হব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশে প্রভাব
পৃথিবীর শুরু থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনশীল, অন্তত ভূতাত্ত্বিক সময়পঞ্জিকা আমাদের তা-ই বলে। ফলে এক মিলিয়ন বছর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কয়েকটি বরফ ও উষ্ণ যুগ এসেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন সমীক্ষা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে পৃথিবীর জলবায়ু পদ্ধতির পরিবর্তনে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর অবদান রয়েছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পৃথিবীর তাপমাত্রার চড়াই-উতরাইয়ে অতীতে যেমন মুখ্য নিয়ামক ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড, ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে।
এখন কথা হচ্ছে, বরফ ও উষ্ণ যুগ পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতে ছিল, তাহলে বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন কেন এত বেশি আলোচিত? এর একমাত্র কারণ, বিশ্বব্যাপী মনুষ্য কর্মকাণ্ড, যেমন নগরায়ণের হার, কলকারখানার পরিমাণ, বনভূমির উজাড় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সম্প্রতি এতটাই বেড়েছে, যার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। এতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বর্তমান জলবায়ুর এই পরিবর্তনকে আমরা ‘মানবসৃষ্ট’ বলি। কারণ, অতীতের জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো ছিল প্রাকৃতিক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমাদের সুন্দর এই ধরিত্রী নিকট ভবিষ্যতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। কারণ, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলের উচ্চ ও নিম্নস্তরে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। আর তাই আর্দ্র অঞ্চল আর্দ্রতর ও শুষ্ক অঞ্চল শুষ্কতর হবে। ফলে মানুষের জীবনধারণ বা টিকে থাকাই হয়ে উঠবে দুরূহ।
যদিও জলবায়ুর পরিবর্তন একটা বৈশ্বিক সমস্যা, তবু উন্নয়নশীল বা অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব হবে ভয়ংকর ও সামঞ্জস্যহীন। কেননা, এসব দেশে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপাদান, জ্ঞানবিজ্ঞান ও কলাকৌশলের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর জনগণের উন্নত জীবনযাপনের বলি হচ্ছে বা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। জ্বলন্ত একটা উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরাই হব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। মূলত ভৌগোলিক অবস্থান, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের ঝুঁকিকে দিন দিন প্রসারিত করছে। ফলে আবহাওয়ার বিভিন্ন চলক, যেমন বৃষ্টিপাত ও গড় তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের অভিঘাত বৃদ্ধিতে অর্থনীতির খাতওয়ারি প্রভাব ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে, যা সামনের দিনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে যেতে পারে। মানুষের জীবন–জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো সংক্ষেপে দেখা যাক।
গবেষণায় দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা ব্যাপক, যা খুবই উদ্বেগের। গত ৫০ বছরে (১৯৬৮-২০২৪) দেশে দিন ও রাতে উষ্ণতার হার বেড়েছে। একইভাবে দিন ও রাতের শীতলতা ভীষণ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ গত পাঁচ দশকে উষ্ণ দিনের সংখ্যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রতিবছরে গড়ে শূন্য দশমিক ৩৯৪ দিন এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে শূন্য দশমিক ১৫ দিন করে বেড়েছে। এ ছাড়া উষ্ণ দিনের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে শূন্য দশমিক ৫০৭ দিন করে প্রতিবছর বাড়ছে। তাপমাত্রার তুলনায় বৃষ্টিপাতের সূচকগুলো অপেক্ষাকৃতভাবে কম পরিবর্তিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভারী ও প্রচণ্ড ভারী বর্ষণের পরিমাণের সংখ্যা। বরিশাল, দিনাজপুর, ফরিদপুর, ও রাজশাহীতে বার্ষিক ভারী বর্ষণের দিন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলোয় খরা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। উত্তরবঙ্গের মতো পুরো দেশে বৃষ্টিপাত কমলেও নগর এলাকাগুলোতে ভারী ও চরম বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা বাড়ছে, প্রকট হচ্ছে জলাবদ্ধতা। গত পাঁচ দশকে দেশের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ টানা শুষ্ক দিনের সংখ্যাও কমেছে। আরও শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, উপকূলীয় নিম্নভূমির এলাকাগুলোতে বৃষ্টিপাতের হার দিন দিন বাড়ছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত আচরণ কৃষিক্ষেত্রে যেমন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত করছে, তেমনি চিরায়ত কৃষিচিত্র পাল্টে গেলে কর্মসংস্থান হ্রাসের কারণে জীবিকার সংকট তীব্রতর হবে। এ বছর এপ্রিল মাসে তাপমাত্রার আকস্মিক অভিঘাতে ধানের উৎপাদন কিছু কিছু জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে হিটশক আমাদের জন্য একটা নতুন চ্যালেঞ্জ, যা অতীতে ছিল না বা থাকলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার পলি মাটি দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতল ভূমি, যার মধ্যে নদীব্যবস্থার ব্যাপ্তি ১৭৫ মিলিয়ন হেক্টর। কিন্তু এর মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। এই ছোট্ট অংশ দিয়েই বন্যার সময় সেকেন্ডে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ ঘনমিটার পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ে। একসঙ্গে এত পানি নির্গমনের বিবেচনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম। জলবায়ু পরিবর্তনে আকস্মিক ও অনিয়মিত বন্যার প্রকোপ দেশে বাড়ছে বলে আমাদের গবেষণায় দেখা যায়। ২০২৪ সালে এমনটা হয়েছে এবং নদীভাঙনও ছিল ভয়াবহ। অতীতে অনেক বড় বড় বন্যা দেশে হয়েছে এবং আমাদের অভিযোজন কৌশল ছিল কার্যকর। কিন্তু চরম ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত বাড়লে বন্যার স্থানিক ও কালিক ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। সুতরাং, বর্তমান অভিযোজন কৌশল খুব কমই ফলপ্রসূ হবে। বন্যার অস্বাভাবিক আচরণে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি যত্রতত্র ভূমির উন্নয়ন, যেমন রাস্তাঘাট, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণও সমভাবে দায়ী। যদিও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধির প্রমাণ এখন পর্যন্ত কম, তবু যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোর তীব্রতা অতীতের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় বেশি হবে বা হচ্ছে। যেমন মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে উপকূলের বিস্তীর্ণ অংশে জোয়ারের ভয়াবহতা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে জোয়ারের তাণ্ডবে ফসলি জমিসহ গবাদিপশুর ক্ষতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ, দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আশানুরূপ উন্নতিতে প্রাণহানি কমলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি। যেমন ২০১৮ সালে আবহাওয়ার আকস্মিক ও চরম ঘটনার জন্য দেশে প্রাক্কলিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার