কোন পথে যাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি?
ইরানের সাবেক শাসক রেজা শাহ পাহলবির পতনের পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে আমেরিকার সাথে একের পর এক উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। ইসলামী বিপ্লবের পর একটি বিপর্যস্ত দেশ ছিলো ইরান। তখন আমেরিকা ইরাকের সাথে তাদের যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। সেই সময় ইরান অত্যান্ত সক্ষমতার সাথে পরিস্থিতি সামলে নেয়। যুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইরান তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। ইরানকে বেধেঁ রাখার জন্য, ইরানের প্রভাব বর্হিবিশ্বে কমানোর জন্য আমেরিকা সকল প্রকার কৌশল প্রয়োগ করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা উল্ল্যেখ করার মতো। মধ্য প্রাচ্যের এমন কোন দেশ নেই যেখানে ইরানের কিছুনা কিছু প্রভাব নেই। বিশেষ করে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রাহীরা, কাতারের বতর্মান সরকার, ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরানের ঘনিষ্ট মিত্র। লিবিয়া, ওমান, আরব আমিরাত, এমনকি সৌদিতেও ইদানিং ইরানিদের পক্ষে অনেক তরুনকে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তির দেশ তুরস্কের কথা উল্লেখ করার মতো। যেখানে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর আমেরিকার সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন আরম্ভ হয়। তুরস্ক যে ফতেউল্লাহ গুলেনকে অভিযুক্ত করেছে আমেরিকা তাকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছে। এই ঘটনায় তুরস্ক ও আমেরিকা ন্যাটোভূক্ত রাষ্ট্র হওয়ার পরও পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তুরস্ক রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পরে এবং রাশিয়া ইরানের পক্ষে অবস্থান ধরে রেখেছে। তুরস্ক প্রথম দিকে সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও এখন সেখান থেকে অনেকটাই সড়ে এসেছে। সবমিলিয়ে ইরানের সাথে রাশিয়ার সামরিক বাণিজ্য, তুরস্ক ও আমেরিকার মতানৈক্যের প্রেক্ষিতে তুরস্ক রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং আসাদ সরকারের বিরোধিতা থেকে সড়ে আসা ইরানের জন্য সবচেয়ে বেশি লাভজনক হয়েছে। দীর্ঘ সময় থেকে মুসলিম রাষ্ট্র গুলোতে আমেরিকার প্রভাব থাকার পরও বর্তমান সময়ে ইরানের অবস্থান বেশ সুবিধাজনক। যদিও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে আমেরিকা বিশ্বের এক নাম্বার এবং তার প্রধান মিত্র ইসরায়েল সতেরো নাম্বারে আছে। তারপরও চৌদ্দ নাম্বার সামরিক শক্তির দেশ ইরান বর্তমানে অনেক বেশি প্রভাব তৈরীতে সক্ষম হয়েছে।
প্রিয় পাঠক আমি বলতে চেয়েছিলাম ইরান আমেরিকার দ্বন্দ্ব নিয়ে। ইরান আমেরিকার এই চলমান দ্বন্দ্ব নিয়ে একেক জন বিশ্লেষকের একেক মত। তবে অধিকাংশের ধারনার ব্যতিক্রম একটা ধারণা আমি খুঁজে পেয়েছি। অধিকাংশ বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মনে করেন সেটা মুসলিম বিশ্বের সাথে খ্রিষ্টান শক্তির দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ এটি একটি ধর্র্ম ভিত্তিক সংঘাত। আমি এই মতটির সাথে একমত হতে পারিনা। আমার কাছে মনে হয় এটি নিছক কোন ধর্ম ভিত্তিক সংঘাত-সংঘর্ষ নয়। এটি শুধুমাত্র মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের বিরোধ নয়।
বিশ্বের মোড়ল আমেরিকার অর্থনীতি অন্যান্য দেশের অর্থনীতির মতো নয়। এখানে তাদের সামরিক বাহিনীর অধীনে রয়েছে বৃহৎ বৃহৎ সামরিক ইন্ডাষ্ট্রি। এই সামরিক ইন্ডাষ্ট্রি গুলোই হলো আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। পক্ষান্তরে অন্যান্য ইন্ডাষ্ট্রির মধ্যে বৃহৎ মূলধনের অধিকারি ইসরায়েলি ধনকুবেরা। স্বাভাবিক ভাবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আমেরিকাকে দরকার আবার আমেরিকার অর্থনীতির স্বার্থে তাদের ইসরায়েলকে দরকার। এই যে উভয়ের স্বার্থে উভয়কে উভয়ের প্রয়োজন। আর এর প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্য তৈরী হয়েছে। এবার মূল কথায় আসি- ইসরায়েলের শত্রু কারা? আমরা সবাই জানি একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে জোর পূর্বক দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম। ফিলিস্তিনিরা এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি এবং পারবেও না। দীর্ঘ দিন থেকে ওরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত আছে। স্বাভাবিক ভাবেই একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ ইসরায়েল দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো বসে থাকতে পারেনি। সবাই ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশও এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে ইসরায়েলের বিপক্ষে অবস্থান পরিস্কার করেছে। এবার মূল কথায় আসি, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্ত মুসলিম বিশ্বই হলো ইসরায়েলের দুশমন। এখন বন্ধুর দুশমন যারা তারা আমেরিকারও দুশমন। তবে আবারও বলছি মূল কারণ কিন্তু আমেরিকার অর্থনিতি। আমেরিকাকে ইসরায়েলি বিনিয়োগ ধরে রাখতে হলে ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। আর ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হলো আমেরিকাকে দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়া। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। আমেরিকা বন্ধু ইসরায়েলের শত্রুকে দমন বা ধ্বংস করতে গিয়ে দেখলো তাদের সামনে এক বিশাল সম্ভাবনা। সেটা হলো অস্ত্রবাণিজ্য। মুসলিম দেশ গুলোকে ধ্বংস করার জন্য একের সাথে অপরের দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দেওয়া হলো এবং উভয় পক্ষের কাছে আমেরিকা দেদারছে অস্ত্র বিক্রি করে চললো। তাই নির্দিধায় বলা যায় আমেরিকার অস্ত্র বাণিজ্য বা সামরিক বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধাতে হবে অথবা নিজেকে যুদ্ধ করতে হবে অথবা যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে।
বাস্তবতা হলো আমেরিকা-ইসরায়েলের কৌশল ও সামরিক-কুটনৈতিক শক্তির কাছে মুসলিম বিশ্ব বরাবরই পরাজিত। অধিকাংশ আরব দেশে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকায় ক্ষমতা রক্ষার জন্য অনেকেই আমেরিকার কাছে নতজানুু ভূমিকায় উপনিত হয়। যেমন সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, আরব-আমিরাত, কুয়েত ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে ইরান সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমেরিকা যখন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তখন ইরান শুধুমাত্র সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেনি বরং সে এক নতুন বুদ্ধিভিত্তিক কৌশল প্রণয়ন করলো। সেখানে তারা তিনটি বিষয়ে সক্ষমতা বাড়িয়েছে। প্রথমত আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির জন্য নিপিড়িত-নির্যাতিত দেশ ও গোষ্টিগুলোর প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত শিক্ষা, গবেষনা বিশেষ করে সামরিক উপকরণে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। তৃতীয়ত আমেরিকা-ইসরায়েল বিরোধী সকল শক্তিকে কোনো না কেনো ভাবে আস্থায় নেয়া।
এই তিনটি প্রক্রিয়ার পূর্ণ বাস্তবায়নে যে ব্যক্তি মূল কাজ করেছেন তিনি হলেন কাশেম সোলায়মানী। স্বাভাবিক ভাবেই আমেরিকা-ইসরায়েলের সমস্ত আক্রোশ তার উপর পতিত হয়। দীর্ঘ বিশ বছর চেষ্টার পর অবশেষে হত্যার মধ্যে দিয়ে আমেরিকা তাদের সে আক্রোশের সমাপ্তি টানে।
নি:সন্দেহে ইরান তাদের একজন বড় মাপের জেনারেলকে হারিয়েছে। ক্ষতি তো তাদের হয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বড় লাভ হলো, যে ইরাকের সাথে দীর্ঘ সময় ইরান যুদ্ধ করলো সেই ইরাকই এখন তাদের অন্যতম মিত্র। ইরাক থেকে মার্কিন সেনা এবং বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য তারা পার্লামেন্টে বিল পাস করেছে। যে সৌদি আরবের সাথে এত বিরোধ, অবিশ্বাস, সন্দেহ সেই সৌদি আরব অনেকটা নমনীয় হয়েছে। তুরস্ক বলেছে যে কোন পরিস্থিতিতে তারা ইরান ও ইরাকের পাশে আছে। ইতিমধ্যে ইরান তাদের কথা অনুযায়ী সামরিক হামলার জবাব সামরিক হামলার মাধ্যমে দিয়েছে। আমেরিকা ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ইরান কর্তৃক ভূলক্রমে ভূপাতিত করার ঘটনায় ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ইরান মূল ঘটনাটি প্রকাশ করে এবং অনিচ্ছাকৃত ভূলের জন্য ক্ষমা চেয়ে আমেরিকার সেই আশাটাও নষ্ট করে দেয়। ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বহি:বিশ্ব সহ নিজ দেশে ব্যাপক তোপের মুখে পড়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে আমেরিকা-ইসরায়েল বৃহৎ শক্তি হওয়ার পরও বেশ অসুবিধায় পড়েছে। এটা স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন প্রভাব কমতে শুরু করেছে। পক্ষান্তরে ইরান ও তুর্কি প্রভাব বেড়েছে অনেক গুণ। ইরান বলেছে আমেরিকাকে মধ্যেপ্রাচ্য ছাড়তে হবে। দেখার বিষয় তিনটি প্রথমত: ইরান যে তিন কৌশলে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এই পর্যায়ে এসেছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে কিনা?
দ্বিতীয়ত: তুরস্ক, সিরিয়া, পাকিস্তান, কাতার, হুতি বিদ্রোহী, হিজবুল্লাহ ও হামাস তাদের মিত্র ইরানের সাথে থেকে মার্কিন প্রভাব কমাতে পারে কিনা? অর্থাৎ ইসরায়েলের পতন ও ফিলিস্তিনিদের বিজয়ের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় কিনা? এবং তৃতীয়ত: যদি আমেরিকা ব্যর্থ হয় তা হলে ইসরায়েলের পতন নিশ্চিত। ইসরায়েলের পতন হলে মার্কিনিদের সামরিক বাণিজ্যের অনেক পথই বন্ধ হয়ে যাবে। ইসরায়েলের বিনিয়োগে ধ্বস নামবে। এর ফলশ্রুতিতে আমেরিকার সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাবে কয়েকগুণ। মূল বিষয় হলো আমেরিকা আর বিশ্বের মোড়ল থাকবে না। দেখার বিষয় তখন নতুন মোড়লকে কে হয়। রাশিয়া, তুর্কি, চীন না কি মূল চালিকা শক্তি ইরান?
লেখক: সমাজকর্মী, কবি ও কলামিষ্ট
এশিয়াবিডি/ডেস্ক/সাইফ