আশ্রয়


সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার ছিল। একটু বেলা হতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সেলিমকে বৃষ্টির মধ্যেই রেনকোট পরে বাইক নিয়ে অফিসে যেতে হল। এই অঞ্চলে সে নতুন এসেছে। বদলির চাকরি তার। আজ এখানে তো কাল সেখানে! এখনও বিয়ের বাঁশি বাজানো সম্ভব হয়নি। তাই একেবারে ঝাড়া হাত পা। মা, বাবাকে এখানে এসে থাকতে বলেছিল কিন্তু তারা দেশের বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকতে নারাজ।

দুপুরের পর থেকে বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ল। এ যেন একেবারে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। দেখতে দেখতে মাঠ, পুকুর আর সেলিমের অফিসের সামনের জমিগুলো একেবারে জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো। অফিসের সবাই বলাবলি করছে এবারের বন্যায় তাদের অফিসেও পানি ওঠতে যাচ্ছে। বলতে বলতে জরুরী ই-মেইল এসে হাজির। এলাকার দুর্গতদের জন্য ত্রাণ শিবির খোলা হবে সেলিমদের অফিসের দোতলায়।

কিছুক্ষণ পর পুলিশের নৌকা কিছু পরিবারকে নিয়ে এখানে উপস্থিত হলো। তাদের দুরাবস্হা দেখে সেলিমের চোখে জল চলে এলো। খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য সে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের নৌকো করে স্থানীয় বাজারের উদ্যেশ্যে রওয়ানা হল।

বাজার শেষ করে ফেরার পথে দেখল তাদের চলতি পথেই একটা ভাসমান ডিঙ্গি এগিয়ে যাচ্ছে। ডিঙ্গিতে বসা বিধ্বস্ত এক মহিলা। কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। একজন হাড্ডিসার পুরুষ অনেক কষ্টে বৈঠা বেয়ে যাচ্ছে কঁঞ্চির মতো দু’টি হাতে। সেলিমদের নৌকা যখন তাদের পাশ কাটাবে ঠিক তখন সে হতবাক হয়ে গেল। অদ্ভত এক শিহরণ তার সমস্ত অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিল। তার মস্তিষ্কের কোষে যেন একটা ভিমরুল হুল ফুঁটালো। পারুলের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে এ কথা সে জীবনেও ভাবেনি!

পারুলও অক্ষিকোঠরে বসে যাওয়া দু’টি চোখের দৃষ্টিতে সেলিমকে দেখলো। শুধু দেখা আর চিনতে পারা ছাড়া পারুলের আর কোন কিছু অনুভূত হলো কিনা সে নিজেও বুঝলো না। তার ক্ষুধার্ত উদর আর লাবণ্য হারানো দেহে যেন এখন আর সেলিম নামের কারও অস্তিত্বই নেই। তার অস্তিত্বে এখন শুধু বিচরণ করছে বৈঠা হাতে অবিচল বসে থাকা অভূক্ত স্বামী আর রোগাক্রান্ত দশ মাস বয়সি মেয়েটা।

সেলিমের ভাবনার আকাশে মেঘ জমে উঠলো- যদিও তাদের নৌকাটা অনেকটা এগিয়ে গেছে পারুলদের ডিঙ্গি অতিক্রম করে। অতীত ভাবছে সেলিম! ভাবছে পারুলের পুরাতন অস্তিত্ব। ভাবছে সেই সময়ের উদাসী প্রহরের কথা। ভাবছে পারুলের ঘামের গন্ধে মাতাল হওয়া সময়ের কথা! পারুল ছিল শুধুই তার- সেও ছিল পারুলের। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু স্তবির হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের নোটিশে। সেলিম তখন শত শত মাইল দূরে জীবন গড়ার জন্য সার্টিফিকেট অর্জনে ব্যস্ত ছিল। অতঃপর অর্জিত সনদ নিয়ে যখন পারুলের স্বপ্ন দেখে দেখে ফিরে এলো, তখন পারুলরা চলে গিয়েছিল ঠিকানা ছেড়ে। সেলিম অবশ্য পারুলকে খোঁজে বের করেছিল ছয় মাসের মধ্যে। তবে ততক্ষণে পারুল অন্যের ঘরণী হয়ে গেছে। তাই আড়ল থেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে।

ভাবনা সমাপ্তির আগেই সেলিম তার অফিসে ফিরে এলো। কিছুক্ষণ পর পারুলরাও এলো আশ্রয়ের জন্য। সেলিমের অফিসে আশ্রিত পারুল জানালো নির্মম আর এক কাহিনী। বিয়ের দুই মাসের মাথায় তার স্বামী হঠাৎ একদিন হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মারা যায়। বিধবা পারুলের পরে আবার বিয়ে হয়। মোটামুটি ভালোই ছিল তার দ্বিতীয় সংসার। অল্প কিছু জমিজমা ছিল তার স্বামীর- যা দিয়ে তাদের ভালোভাবেই চলে যেত। কিন্তু গত বর্ষায় নদীর বুকে বিলিন হয়ে গিয়েছিল তাদের সব সহায় সম্বল। সর্বশেষ আশ্রয় ভিটেটাও গেল গত দিন- নদীর বুকে। এখন তাদের আর কিছুই নেই। অভূক্ত থেকে থেকে হাড্ডিসার হয়ে যাওয়া এক স্বামী আর অচঞ্চল চোখে ফেল ফেল করে চেয়ে থাকা একটা ছোট্ট মেয়ে ছাড়া পারুলের আজ আর কিছুই নেই।

সেলিমের আকাশে ঘন মেঘ জমে ঝড় সৃষ্টি করে। পারুলকে সে এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসে। তার মনের কোণে উকি দেয়া অদ্ভুত ভাবনা- সে পারুলকে আশ্রয় দেবে তার বুকে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব এ কথা ভেবে পায় না। পারুলের স্বামী আছে, একটা মেয়ে আছে!

রাত দ্বি-প্রহরে পারুলের কান্নায় ত্রাণ শিবিরের সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পারুল একসাথে তার সর্বশেষ আশ্রয় স্বামী এবং মেয়ে দু’জনকেই চিরতরে হারিয়েছে। লাশ হয়ে পড় রয়েছে তারা!

কিভাবে কি হলো কেউ বুঝে উঠতে পারলনা। শুধু সেলিম জানে- কিভাবে কি হয়েছে। তবে নিজেকে সে সান্ত্বনা দেয়- এই দু’টি মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনায় তার কোন হাত ছিল না। তবে সে হয়তো জানে না- পারুল আর তার বুকে আশ্রয় নেবে না কোনদিন।

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক
কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার থেকে।

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ