জাহান্নামীদের কবর কেমন হবে

কবরের আজাব ও তার শাস্তির উপরে প্রত্যেক মুসলমানের ঈমান রাখতে হবে। যা প্রদত্ত হবে তার উপযুক্ত যারা তাদের উপরে। আর এগুলো চির সত্য এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অন্ধকার কবর জান্নাতের উদ্যানসমুহ হতে একটি উদ্যান হবে নতুবা জাহান্নামের গর্তসমুহ হতে একটি গর্ত হবে। তাই আজ আমরা কুরআন-হাদিসে আলোকে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করব জাহান্নামীদের কবর কেমন হবে। (ইনশা আল্লাহ)

কবরের আযাব সত্য

কুরআন-হাদিসের বহু দলিল দ্বারা প্রমাণিত কবরের শান্তি ও শাস্তির বিধান। বিশেষ করে যারা কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও গুনাহগার তাদের জন্য অনেক কঠিন শাস্তি রয়েছে অন্ধকার কবরে। আর এই শাস্তি অব্যাহত থাকবে কিয়ামাত সংগঠিত হওয়া পর্যন্ত। সূরা আল-মুমিনুন এর ৯৯ ও ১০০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব, আমাকে ফেরত পাঠান। যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কখনো নয়, এটি একটি বাক্য যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বরযখ (কবর)”।

কাফির-মুশরিকদের যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে তখন তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে যে আবেদন পেশ করবে সে কথা তুলে ধরা হয়েছে। মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তায়ালার কাছে আবেদন করবে হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়াতে আবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন, যাতে ফেলে আসা জীবনের ভুলগুলো সংশোধন করতে পারি। এ আকাঙ্খা প্রত্যেক কাফির-মুশরিক মৃত্যুর সময় করবে।

তাদের এমন আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আর কোন সুযোগ দেওয়া হবে না। সুতরাং যা আমল করার তা কবরে যাওয়ার পূর্বেই করতে হবে। কারণ সেখানে চলে গেলে আর কোন আমল করার সুযোগ পাওয়া যাবে না। কেননা কবর হল এমন একটি জায়গা যা দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে প্রতিবন্ধক। যেখানে সৎ বান্দারা আরাম-আয়েশ ও নেয়ামত ভোগ করবে আর অবাধ্যরা শাস্তি ভোগ করবে। আর তা হবে মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। আর এতে কবরস্থ করা হোক আর নাই করা হোক।

সুনানে আন-নাসায়ী শরীফের হাদীসে এসেছে-

“হযরত আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কবরের আযাব সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, হ্যাঁ! কবরের আযাব সত্য, আয়শা (রাঃ) বলেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে এমন কোন সালাত আদায় করতে দেখিনি যাতে তিনি কবরের আযাব থেকে পানাহ না চেয়েছেন”।

সহিহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে-

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ঐ দুজনকে আযাব দেয়া হচ্ছে আর কোন কঠিন কাজের কারণে তাদের আযাব দেয়া হচ্ছে না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হ্যাঁ (আযাব দেয়া হচ্ছে) তবে তাদের একজন পরনিন্দা করে বেড়াত, অন্যজন তার পেশাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না। (রাবী বলেন) অতঃপর তিনি একটি তাজা ডাল নিয়ে তা দুখন্ডে ভেঙ্গে ফেললেন। অতঃপর সে দুখন্ডের প্রতিটি এক এক কবরে পুঁতে দিলেন। অতঃপর বললেন- আশা করা যায় যে এ দুটি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের উভয়ের আযাব হালকা করা হবে”।

কবরে সকাল সন্ধ্যা আগুন উপস্থিত করা হবে

একজন জাহান্নামী ব্যক্তির কবরে সকাল সন্ধা আগুন উপস্থিত করে তার অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হবে। কুরআনুল কারীমের সূরা গাফির এর ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আগুন! তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়। আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে (সেদিন ঘোষণা করা হবে), ফিরাউনের অনুসারীদেরকে কঠোরত আযাবে প্রবেশ করাও”।

 সহিহ বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-

“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- তোমাদের কেউ মারা গেলে অবশ্যই তার সামনে সকাল ও সন্ধ্যায় তার অবস্থান স্থল উপস্থাপন করা হয়। সে জাহান্নামী হলে, তাকে জাহান্নামীদের (অবস্থান স্থল দেখানো হয়) আর তাকে বলা হয়, এ হচ্ছে তোমার অবস্থান স্থল, ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তোমাকে পুনরুত্থিত করা অবধি”।

 কবরে ফিৎনার সম্মুখীন হতে হবে

কবরের ফিৎন বড় কঠিন ফিৎনা। সুনানে আন-নাসায়ী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে লোকজন যে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে দাঁড়িয়ে তার উল্লেখ করতে থাকলে মুসলমানগণ এমন উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন যে, আমার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা শুনতে বাধা সৃষ্টি হতে লাগল। যখন কান্নাকাটি থেমে গেল তখন আমি আমার নিকটবর্তী এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে আল্লাহ তায়ালা রহম করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কথার শেষে কি বলেছিলেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আমার নিকট ওহী এসেছে যে, তোমরা দাজ্জালের ফিৎনার ন্যায় কবরে ফিৎনার সম্মুখীন হবে”।

আঘাতের কারণে চিৎকার করতে থাকবে

জাহান্নামীদের কবরে এমন ভাবে আঘাত করা হবে যার জন্য কবরবাসী চিৎকার করতে থাকবে।
সহিহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতটুকু মাত্র দূরে যায় যে, সে তখনও তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়। এ সময় দুজন ফেরেশতা তার নিকট এসে তাকে বসান এবং তাঁরা বলেন, এ ব্যক্তি অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তুমি কী বলতে? তখন মুনাফিক বা কাফির ব্যক্তি উত্তরে বলবে, আমি জানি না। লোকেরা যা বলত আমি তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, তুমি না নিজে জেনেছ, না তিলাওয়াত করে শিখেছ। আর তাকে লোহার মুগুর দ্বারা এমনভাবে আঘাত করা হবে, যার ফলে সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠবে যে, দুজাতি (মানুষ ও জ্বিন) ছাড়া তার আশপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে”।

সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে এসেছে-

“হযরত জারীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- অতঃপর তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ী থাকবে, যদি এ দ্বারা পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধূলায় পরিণত হয়ে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারপর সে তাকে হাতুড়ী দিয়ে সজোরে আঘাত করতে থাকে, এতে সে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে যা মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত সকল সৃষ্টি জীবই শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। তিনি বলেন, অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রুহ ফেরত দেয়া হয়”।

 জমীন চাপ দিতে থাকবে

মৃত্যু ব্যক্তি জমীনের উপর থেকে জমীনের ভিতরে যাওয়ার পর যদি জাহান্নামী হয় তাহলে জমীন তাকে চাপ দিতে থাকবে। তিরমিজী শরীফের হাদীসে এসেছে- “আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- মৃত লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরের মধ্যে রাখা হয় তখন কালো বর্ণের এবং নীল চোখ বিশিষ্ট দু’জন ফেরেশতা আসেন তার নিকট। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার এবং অন্যজনকে নাকীর বলা হয়। তারা উভয়ে (মৃত ব্যক্তিকে) প্রশ্ন করেনঃ তুমি এ ব্যক্তির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রসঙ্গে কি বলতে? মৃত লোকটি যদি মুনাফিক হয় তাহলে (প্রশ্নের উত্তরে) বলবে, তার প্রসঙ্গে লোকেরা একটা কথা বলত আমিও তাই বলতাম। এর বেশি কিছুই আমি জানি না। ফেরেশতা দু’জন তখন বলবেন, আমরা জানতাম, এ কথাই তুমি বলবে। তারপর যমীনকে বলা হবে, একে চাপ দাও। সে লোককে এমন শক্ত করে জমীন চাপা দেবে যে, তার পাঁজরের হাড়গুলো পরস্পরের মাঝে ঢুকে পরবে। (কিয়ামাতের দিন) আল্লাহ তাকে তার এ বিছানা হতে উঠানো পর্যন্ত সে লোক এভাবেই আযাব পেতে থাকবে”।

জাহান্নামের পোষাক ও বিছানা দেওয়া হবে

দুনিয়ার জমীনে অনেক দামী পোষাক পরিধান করেছেন। অনেক উন্নত মানের বিছানার মধ্যে শুয়ে আরাম করেছেন। বিশাল বাসা বাড়ি ছিল। কিন্ত যদি মরণের পর জাহান্নামী হন তাহলে অন্ধকার কবরে আগুনের পোষাক ও বিছানা পাবেন। আর বিশাল বাসা বাড়ির বদলে খুব সংকীর্ণ এক কবর পাবেন। সুনানে আবু দাউদ শরীফের এসেছে- “হযরত আল-বারাআ ইবনে আবিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, তার রূহকে তার শরীরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার রব কে? সে উত্তর দেয়, হায়! আমি কিছুই জানি না। তারপর তারা প্রশ্ন করেন, তোমার দ্বীন কি? সে বলে, হায়! আমি কিছুই জানি না। তারা প্রশ্ন করে, এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? সে বলে, হায়! আমি তো জানি না। তখন আকাশের দিক হতে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন, সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং, তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা এনে বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোষাক পরিয়ে দাও, আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দরজা খুলে দাও। তিনি বলেন, অতঃপর তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে। এছাড়া তার জন্য তার কবরকে সংকীর্ণ করে দেয়া হয়, ফলে তার এক দিকের পাঁজর অপর দিকের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে যায়”।

 কবরের শাস্তি হতে পানাহ চাওয়া

কবরের শাস্তি হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দোয়া করতেন। সহিহ বুখারী শরীফের হাসীসে এসেছে- “হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার সমীপে পানাহ চাচ্ছি কবরের শাস্তি হতে, জাহান্নামের শাস্তি হতে, জীবন ও মরণের ফিতনা হতে এবং মাসীহ দাজ্জাল এর ফিতনা হতে”।

 বায়হাক্বী শরীফের হাদীসে এসেছে-

“হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তি হলো পানিতে পড়া ব্যক্তির মতো সাহায্যপ্রার্থী। সে তার পিতা-মাতা, ভাই-বন্ধুর দোয়া পৌঁছার প্রতীক্ষায় থাকে। তার কাছে যখন দোয়া পৌঁছে, তখন তার কাছে সারা দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে এ দোয়া বেশি প্রিয় হয়। আর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াবাসীদের দোয়ায় কবরবাসীদেরকে পাহাড় পরিমাণ রহমত পৌঁছান এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্য জীবিতদের পক্ষ থেকে উপহার হলো তাদের জন্য ক্ষমা চাওয়া”।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে মরণের আগে কবরের শাস্তি ও ফিৎনা থেকে বেঁচে থাকার ছামানা জোগাড় করার তৌফিক দান করুন। আমরা আল্লাহর কাছে পানা চাচ্ছি কবরের শাস্তি ও ফিৎনা থেকে। তিনি যেন আমাদের সবাইকে পানা দান করেন। (আমিন)

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কামরান
আরও সংবাদ