রহমতে আলম (সাঃ) : সু-মহান মর্যাদা (পর্ব দুই)

আল্লাহ তায়ালা হলেন রাব্বুল আলামীন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন রাহমাতুল্লীল আলামীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত। সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “আপনাকে আমি সারা বিশ্ববাসীর জন্য রহমতরূপেই পাঠিয়েছি”। সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালতের উপর ঈমান আনবে সে আসলে উক্ত করুণা ও রহমতকে গ্রহণ করবে। পরিণামে দুনিয়া ও আখিরাতে সে সুখ ও শান্তি লাভ করবে। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত বিশ্বজগতের জন্য, সেহেতু তিনি বিশ্বজগতের রহমত রূপে, অর্থাৎ নিজের শিক্ষা দ্বারা বিশ্ববাসীকে ইহ-পরকালের সুখের সন্ধান দিতে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিছু উলামা তাঁকে এই অর্থেও বিশ্বজগতের জন্য করুণা বলেছেন যে, তাঁর কারণেই এই উম্মত (তাঁর দাওয়াত গ্রহণ অথবা বর্জনকারী মুসলিম অথবা কাফের সকলেই) নির্মূলকারী ব্যাপক ধ্বংসের হাত হতে রেহাই পেয়েছে। যেভাবে পূর্ববর্তী বহু জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, উম্মাতে মুহাম্মাদিয়াকে ঐ রকম আযাব দিয়ে ধ্বংস করে নির্মূল করা হয়নি। বহু হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, মুশরিকদের উপর বদ্দুয়া ও অভিশাপ না করাও ছিল তাঁর করুণারই একটি বিশেষ অংশ। সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি মুশরিকদের উপর বদ্দুয়া (অভিশাপ) করুন। তিনি বললেন, আমি তো অভিসম্পাতকারীরূপে প্রেরিত হইনি বরং প্রেরিত হয়েছি রহমত স্বরূপ”।

অনুরূপ রাগান্বিত অবস্থায় কোন মুসলিমকে তাঁর অভিশাপ বা গালিমন্দ করাকে কিয়ামতের দিন তার জন্য রহমতের কারণ হওয়ার দোয়া করাও তাঁর দয়ারই একটি অংশ। সুনানে আবু দাউদ শরীফে এসেছে- “হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমার উম্মাতের কাউকে আমি অসন্তুষ্ট অবস্থায় মন্দ বলি বা অভিশাপ দেই কেননা আদম সন্তান হিসাবে আমিও তাদের মতো অসন্তুষ্ট হয়ে থাকি। তিনি আমাকে সৃষ্টিকুলের জন্য করুণার আঁধার করে পাঠিয়েছেন। হে আল্লাহ! আমার গালি ও অভিশাপকে ক্বিয়ামাতের দিন তাদের জন্য রহমতে পরিণত করো”। এখনে প্রশ্ন আসে যে, তিনি মুমিনদের জন্য রহমত। কিন্ত কাফিরদের জন্যে কি করে তিনি রহমত হতে পারেন? এই উত্তরে বলা যেতে পারে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এই আয়াতেরই তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, মুমিনদের জন্যে তো তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে রহমত স্বরূপ ছিলেন। কিন্তু যারা মুমিন নয় তাদের জন্যে তিনি দুনিয়াতেই রহমত স্বরূপ ছিলেন। তারা তাঁরই রহমতের বদৌলতে যমীনে ধ্বসে যাওয়া হতে, আকাশ হতে পাথর বর্ষণ হতে রক্ষা পেয়ে যায়। পূর্ববর্তী অবাধ্য উম্মতদের উপর এই শাস্তি এসেছিল। (ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হলেন হাবিবুল্লাহ।

আল্লাহ তায়ালা নাবী রাসূলদের বিভিন্ন উপাধী দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় উপাধী দিয়ে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সকল নাবী রাসূলদের থেকে আলাদা সম্মানিত করেছেন। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ নিজের প্রিয় বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিরমিজী শরীফের হাদিসে এসেছে- “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কিছু সাহাবী তাঁর প্রতীক্ষায় বসে ছিলেন। রাবী বলেন, তিনি বের হয়ে তাঁদের নিকট এসে তাঁদের কথাবার্তা শুনলেন। তাঁদের কেউ বললেন, বিস্ময়ের বিষয়। আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে (একজনকে) নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানিয়েছেন। তিনি ইব্রাহীম (আঃ) কে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানিয়েছেন। আরেকজন বললেন, এর চেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল মূসা (আঃ) এর সাথে তাঁর সরাসরি কথাবার্তা। আরেকজন বললেন, ঈসা (আঃ) আল্লাহর কালিমা (“কুন” (হও) দ্বারা সৃষ্ট) এবং তাঁর দেয়া রূহ। আরেকজন বললেন, আদম (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের নিকটে বের হয়ে তাঁদেরকে সালাম করে বললেন, আমি তোমাদের কথাবার্তা ও তোমাদের বিস্ময়ের ব্যাপারটা শুনেছি। নিশ্চয় ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সত্যিই তিনি তাই। মূসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালার সাথে বাক্যালাপকারী, সত্যিই তিনি তাই। ঈসা (আঃ) তার রূহ ও কালিমা, সত্যিই তিনি তাই। আর আদম (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেছেন, সত্যিই তিনিও তাই। কিন্তু আমি আল্লাহ তায়ালার হাবীব (প্রিয় বন্ধু), তাতে কোন গর্ব নেই”।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে উচ্চ আওয়াজ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে নিজের কন্ঠস্বর উঁচু করা যাবেনা। সূরা হুজরাতের ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নাবীর কণ্ঠস্বরের ওপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেরা একে অন্যের সাথে যেভাবে জোরে কথা বল সেভাবে তার সাথে জোরে কথা বলো না। তাতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা তা টেরও পাবে না”। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মজলিসের এটা অন্যতম আদব। যারা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মজলিসে ওঠাবসা ও যাতায়াত করতেন তাদেরকে এ আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো। এর উদ্দেশ্য ছিল নাবীর সাথে দেখা-সাক্ষাত ও কথাবার্তার সময় যেন ঈমানদাররা তাঁর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি একান্তভাবে লক্ষ্য রাখেন। কারো কণ্ঠ যেন তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চ না হয়। তাঁকে সম্বোধন করতে গিয়ে কেউ যেন একথা ভুলে না যায় যে, সে কোন কথা বলছে। তাই সাধারণ মানুষের সাথে কথাবার্তা এবং আল্লাহর রাসূলের সাথে কথাবার্তার মধ্যে পার্থক্য থাকতে হবে এবং কেউ তাঁর সাথে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলবে না যেমন পরস্পর বিনা দ্বিধায় করা হয়, কারণ তা এক প্রকার বে-আদবি ও ধৃষ্টতা। সেমতে এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা পাল্টে যায়। তারা এরপর থেকে খুব আস্তে কথা বলতেন। হযরত সাবেত ইবনে কায়েস (রাঃ) কণ্ঠস্বর স্বভাবগতভাবেই উঁচু ছিল। এই আয়াত শুনে তিনি ভয়ে সংযত হলেন এবং কণ্ঠস্বর নীচু করলেন। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাবিত ইবনে কায়েস (রাঃ) কে খুঁজে পেলেন না। একজন সহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছে তাঁর সংবাদ নিয়ে আসছি। তারপর লোকটি তাঁর কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি তাঁর ঘরে মাথা নীচু করে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী অবস্থা? তিনি বললেন খারাপ। কারণ এই (অধম) তার আওয়াজ নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আওয়াজের চেয়ে উঁচু করে কথা বলত। ফলে তার আমাল বরবাদ হয়ে গেছে এবং সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তারপর লোকটি নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ফিরে এসে খবর দিলেন যে, তিনি এমন এমন কথা বলছেন। হযরত মূসা বলেন, এরপর লোকটি এক মহাসুসংবাদ নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে গেলেন (এবং বললেন) নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, তুমি যাও এবং তাকে বল, তুমি জাহান্নামী নও, বরং তুমি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত”।

অনুরূপভাবে রাসূলের কোনো সুন্নাত সম্পর্কে জানার পরে সেটা মানতে গড়িমসি বা সামান্যতম অনীহা প্রকাশ করাও বে-আদবি। এ আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অধীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হুজরা মোবারকের সামনেও বেশি উঁচুস্বরে সালাম ও কালাম করা নিষিদ্ধ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও আদব তাঁর ওফাতের পরও জীবদ্দশার ন্যায় ওয়াজিব। তাই তাঁর পবিত্র রাওদ্বার সামনেও বেশী উঁচুস্বরে সালাম ও কালাম করা আদবের খেলাফ। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে- “হযরত সায়িব ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মাসজিদে নাব্বীতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমার দিকে একটা কাঁকর নিক্ষেপ করলো। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। তিনি বললেন যাও, এ দুজনকে আমার নিকট নিয়ে এস। আমি তাদের নিয়ে তাঁর নিকট এলাম। তিনি বললেন, তোমরা কারা? অথবা তিনি বললেন, তোমরা কোন স্থানের লোক? তারা বললো, আমরা তায়েফের অধিবাসী। তিনি বললেন, তোমরা যদি মদীনার লোক হতে, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের কঠোর শাস্তি দিতাম। তোমরা দুজনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাসজিদে উঁচুস্বরে কথা বলেছো”!

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে অগ্রসর হওয়া।

সূরা হুজরাতের শুরুতেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে কোন কিছু এগিয়ে দিও না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন”। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, সামনে কোন কিছু এগিয়ে দিও না অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কথা বলাকালীন কথা বলতে নিষেধ করা হচ্ছে। (ফাতহুল কাদীর)। সুতরাং দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা যা দেননি ও নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি, করেননি এবং অনুমোদনও দেননি তা করা ও বলা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ এসব করা ও বলা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অগ্রণী হওয়ার শামিল। এখান থেকে আরো শিক্ষা হল যারা জ্ঞানে বড় তাদের সাথে শিষ্টাচার বর্হিভূত আচরণ করা অন্যায়। বরং শ্রদ্ধা রেখে শালীন আচরণ করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মিরাজ।

সকল নাবী রাসূলদের মিরাজ হয়েছে জমিনে কিন্ত রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ হয়েছে জমিন থেকে শুরু করে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে রাব্বুল আলামীনের আরশে আযিমে গিয়ে। সূরা বানী ইসরাঈলের শুরুতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “পবিত্রতা ও মহিমা সেই মহান সত্তার, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমের মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। তাঁকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন”। আবার সূরা নজমের ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “তারপর তিঁনি তাঁর কাছাকাছি হলেন, অতঃপর খুব কাছাকাছি। তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই ধনুক পরিমাণ কিংবা এর চেয়েও কম দূরত্ব ছিল”।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এত বেশি সু-মহান মর্যাদা দান করেছেন তা আমাদের জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করা সত্যিই কঠিন। পবিত্র কুরআন শরীফের প্রায় ৪০ জায়গায় রাব্বুল আলামীন তাঁর নামের সাথে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম মোবারক উল্লেখ করেছেন।

———- চলবে ইনশা আল্লাহ

লেখক: ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মাসজিদ, যুক্তরাজ্য

এশিয়াবিডি/ডেস্ক/কেকে 
আরও সংবাদ